আরব বসন্তের ঢেউ তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়ায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। গণতন্ত্রের দাবিতে শুরুতে সিরিয়ায় ছোটখাটো বিক্ষোভ হয়। দ্রুতই এই বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে নৃশংস পথ বেছে নেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ। এতে এক দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের চক্করে পড়ে যায় সিরিয়া।
বুলেটের মুহুর্মুহু গুলি, বাবা-মা হারানো শিশুদের চিৎকার আর বাস্তুচ্যুত মানুষের ছোটাছুটি- এ যেন সিরিয়ার নিত্যদিনের চিত্র। দেশটিতে ২০১১ সালের মার্চে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কেবলই বেড়েছে লাশের সারি।
২০১৪ সালের পর এই প্রথম সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে মৃত্যুর হিসাব দিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়। আর তাতেই শিউরে উঠলো বিশ্ব। গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় থেকে দেওয়া এই হিসাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে লড়াইরত যোদ্ধাদেরও রাখা হয়েছে।
নিহতের পূর্ণ নাম, মৃত্যুর তারিখ, কোথায় নিহত হয়েছে, সব নিয়ম কঠোরভাবে মেনে এই হিসাব দিয়েছে সংস্থাটি। তবুও বলা হচ্ছে, এই হিসাব আনুমানিক। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যাটা আরও বেশি। কারণ অনেক মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়ায় দশ বছরের যুদ্ধে কমপক্ষে ৩ লাখ ৫০ হাজার ২০৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে, মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বলেছেন, ‘এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা ৩ লাখ ৫০ হাজার ২০৯ জনের মৃত্যুর একটি তালিকা তৈরি করেছি। ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে এসব মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। নিহত প্রতি ১৩ জনের মধ্যে একজন নারী অথবা শিশু।’
মিশেল ব্যাচলেট আরও বলেন, ‘এটা সর্বনিম্ন প্রমাণিত মৃত্যুর সংখ্যা। অবশ্যই প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যাটা বেশি। সিরিয়ায় প্রাণহানি নিয়ে তার কার্যালয় থেকে সবশেষ হিসাব দেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালের আগস্টে। তখন সংখ্যাটা ছিল অন্তত ১ লাখ ৯১ হাজার ৩৬৯ জন।’
সূত্র মতে, সবচেয়ে বেশি ৫১ হাজার ৭৩১ জন নিহত হয়েছে আলেপ্পোতে। দীর্ঘদিন এই অঞ্চলটি বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল মিশেল ব্যাচলেট জানিয়েছেন, আরও পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ মৃত্যুর হিসাব দেওয়ার জন্য তার কার্যালয় পরিসংখ্যানগত একটি মডেল নিয়ে কাজ করছে; যা কিছু মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে বিচারের ভিত্তি তৈরিতে সাহায্য করবে।
এছাড়া দেশটিতে আটক লাখো মানুষ এখনো নিখোঁজ। জাতিসংঘ এর আগে জানিয়েছিল, আটক এসব মানুষ বীভৎস নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট নিখোঁজ এসব মানুষদের নিয়ে তদন্তের জন্য স্বাধীন কোনো কৌশল কিংবা পদ্ধতি তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘সিরিয়ায় বহু মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে, আমি একটি স্বাধীন পদ্ধতি তৈরির জন্য পুনরায় আহ্বান জানাচ্ছি। একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের মাধ্যমে নিখোঁজদের ভাগ্য এবং অবস্থান স্পষ্ট করা, এসব মানুষের দেহাবশেষ চিহ্নিত করা এবং আত্মীয়দের সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করুন।’
তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মনাবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজার্ভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাবে এই যুদ্ধে ৫ লাখ মানুষ মারা গেছে সিরিয়ায়। যাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক। এর বাইরেও নিখোঁজ রয়েছেন বহু মানুষ। সংস্থাটির মতে আরও দুই লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয় দক্ষিণের শহর ডেরায়। তবে বিক্ষোভ শুরুর অনেক আগে থেকেই দেশটিতে কর্মসংস্থানের অভাব আর দুর্নীতির মত নানা কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। স্বতস্ফূর্ত এই বিক্ষোভকে বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দেন প্রেসিডেন্ট আসাদ।
বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয় সরকারি বাহিনী। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি ওঠে দেশজুড়ে। সরকারের অভিযানও জোরদার হলে বিদ্রোহীরা শুরুতে নিজেদের জীবন রক্ষার্থে অস্ত্রধারণ করে। পরে তার একত্রিত হয়ে নিজ এলাকার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় দেশটিতে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা ইরাক ও সিরিয়ার একটা বড় অংশ দখল করে ২০১৪ সালের জুনে কথিত ‘খেলাফত’ ঘোষণা করে। আইএসের কথিত এই খেলাফতের রাজধানী করা হয় সিরিয়ার রাক্কা। আইএস বর্বরতা-নৃশংসতা দিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের কেন্দ্রে চলে আসে। সারা বিশ্বে তারা ত্রাস সৃষ্টি করে। পরে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার পাশাপাশি সিরিয়ার সরকারি বাহিনী, নানান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অভিযানে ২০১৭ সালে আইএসের কথিত খেলাফতের পতন হয়।
দীর্ঘ এই যুদ্ধের কারণে মানুষ সিরিয়া ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর হিসাবে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন মানুষ সিরিয়া ছেড়ে গেছে। লেবানন, জার্মানি, ইরান ও তুরস্ক সিরিয়ার শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। তাদের অনেকে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে আরও ভালো সুবিধা পাওয়ার জন্য।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটেরও জন্ম দিয়েছে। কারণ, সিরিয়ায় বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সিরীয় শরণার্থীরা তুরস্ক, লেবানন, জর্ডানসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
যুদ্ধে সিরিয়ার শহর-নগর-জনপদ বিধ্বস্ত। যেসব বেসামরিক মানুষ এখনো সিরিয়ায় আছে, তাদের জীবন নানাভাবে বিপন্ন-বিপদগ্রস্ত-ঝুঁকিপূর্ণ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, সিরিয়ায় এখন যারা অবস্থান করছে, তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে।
গৃহযুদ্ধ দেশটির জীবনব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এএফপি বলছে, সিরিয়ার পাউন্ড এক দশকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য হারিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক মানবিক সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতি ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই যুদ্ধ যদি এখনই শেষ হয়, তাহলেও ২০৩৫ সাল নাগাদ তার ক্ষতির মূল্য আরও ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হবে।
যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুটি বিষয় যুক্ত করলে সিরীয় যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। শুধু, তা-ই নয়, যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের আয়ুষ্কাল ১৩ বছর কমেছে।
সিরিয়ায় ১০ বছরের গৃহযুদ্ধে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে তাকে মানবতার জন্য এক লজ্জার দশক হিসেবে অভিহিত করেছেন নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের (এনআরসি) মহাসচিব জ্যান এজল্যান্ড।
এসডাব্লিউ/এসএস/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ