তালিবানের পুনরুত্থানে বদলে গেছে পরিস্থিতি। আফগানিস্তান থেকে মাদকের বিপুল মজুত সরিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে চোরাকারবারিরা। এক্ষেত্রে তাদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠেছে ভারত। সম্প্রতি গুজরাট উপকূলে অবৈধ হেরোইনের বড় দুটি চালান জব্দের পর এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষগুলো।
সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাদক চোরাচালানে জড়িত বিভিন্ন চক্র হঠাৎই ভারতে নিষিদ্ধ হেরোইন পাচার বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের নিরাপত্তায় ও পাচার দমনে তৎপর কয়েকটি সরকারি সংস্থা এ দাবি করেছে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি গুজরাট উপকূলে বিপুল পরিমাণ হেরোইন জব্দের ঘটনায় এমন সমীকরণে পৌঁছেছে ভারতীয় গোয়েন্দারা। তাদের মতে, আফগানিস্তানে তালিবানের শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে চাপে রয়েছে মাদক পাচারকারীরা।
সূত্র মতে, ভারতের গুজরাট রাজ্যের মুন্দ্রা বন্দরে প্রায় তিন হাজার কেজি উচ্চমানের হেরোইন আটক করা হয়েছে। রোববার দেশটির রাজস্ব ও গোয়েন্দা অধিদপ্তর (ডিআরআই) হেরোইনের এই চালান আটক করে। আটককৃত মাদকের মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি রুপি হতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা।
এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, অর্থের দিক থেকে এটিই ভারতে মাদকের সবচেয়ে বড় চালান। ডিআরআই জানাচ্ছে, আফগানিস্তানে উৎপাদিত চালানটি ইরানের বন্দর আব্বাসের মাধ্যমে গুজরাটে পাঠানো হয়েছিল। অন্ধ্র প্রদেশের বিজয়ওয়ারা জেলার আশি ট্রেডিং কোম্পানির মাধ্যমে চালানটি ভারতে আসে। ট্যালক পাথরের আড়ালে মাদকের এই বিপুল পরিমাণ চালান দেশটিতে ঢোকে।
ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো (এনসিবি), রাজস্ব গোয়েন্দা অধিদপ্তর (ডিআরআই) ও গুজরাটের সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াডের (এটিএস) কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, আফগানিস্তানে উৎপাদিত হেরোইন ভারতে পাচারে অব্যাহত চেষ্টা চালাচ্ছে অপরাধী চক্রগুলো।
সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, নিরাপদে মাদক পাচারে ইরান হয়ে সমুদ্রপথের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের চেষ্টা করছে চোরাকারবারিরা।
না হলে মাদক সম্রাটদের শঙ্কা, তালিবানের হাতে ধরা পড়লে সোজা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে তাদের। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ হেরোইনের সন্ধান পেলে তালিবান যদি তা জব্দ করে, তাহলে অপ্রত্যাশিত আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা তো আছেই।
ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তালিবানের হাতে হেরোইনের মজুদ বাজেয়াপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে মাদক কারবারিরা। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি তাদের ভয় রয়েছে যে, আফগানিস্তানের নতুন শাসকদের হাতে ধরা পড়লে সরাসরি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এসব কারণ ভারতে মাদকের প্রবেশ বেড়ে গেছে।
এসব কারণেই ভারতে মাদকের অনুপ্রবেশ তীব্র রূপ নিয়েছে বলে জানান গোয়েন্দারা। এনসিবির এক কর্মকর্তা জানান, ভারতীয় জলসীমায় যে অস্বাভাবিক হারে হেরোইনের চালান ধরা পড়ছে, তা উপেক্ষা করার উপায় নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘মুন্দ্রা বন্দরে তিন হাজার কেজি হেরোইন জব্দের বিষয়টি এখনও খতিয়ে দেখছে ডিআরআই। ওই হেরোইন আফগানিস্তান থেকে চোরাই পথে এসেছে। আফিম উৎপাদনে আফগানিস্তান শীর্ষ দেশ। সেই সঙ্গে আফিম থেকে হেরোইন তৈরির জন্য দেশটিতে প্রযুক্তিও আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেভাবে বিপুল পরিমাণ হেরোইন ভারতে ঢোকানোর চেষ্টা চলছে এখন, তাতে এটা স্পষ্ট যে মাদক মাফিয়ারা মজুত খালি করার তোড়জোড় চলছে। তাহলে তালিবানের শাস্তি থেকে বেঁচে যাওয়া আর হেরোইন জব্দে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি কমে যাবে।’
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় ইউএনওডিসির তথ্য অনুযায়ী, আফিমের সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী দেশ আফগানিস্তান। সারা বিশ্বে আফিম সরবরাহের ৮০ শতাংশের বেশি চাষ হয় আফগান ভূখণ্ডে। পপি গাছের বিশেষ একটি প্রজাতির নির্যাস আফিম থেকে হেরোইনসহ বিভিন্ন উচ্চ মাত্রার মাদক তৈরি করা হয়।
জাতিসংঘ আরও জানায়, আফগানিস্তানে আফিম চাষে ২০১৯ সালে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছিল প্রায় ১২ হাজার মানুষের। ধারণা করা হয়, তালিবানের বার্ষিক আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশের উৎস অবৈধ মাদক বাণিজ্য।
ভয়ঙ্কর মাদক মেথ এর উৎপাদন
আফগানিস্তান ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদক দেশ হিসাবে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু হেরোইন তৈরিতে ব্যবহৃত আফিমই শুধু নয়, এবার আরেক ভয়ঙ্কর মাদক মেথাম্ফেটামিনের উৎপাদনও বাড়ছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিতে। গত চার বছর ধরে আফগানরা ব্যাপকহারে মেথাম্ফিটামিন উৎপাদন শুরু করছে।
নেশার জগতে মেথাম্ফিটামিন পরিচিত ক্রিস্টাল, স্পিড বা মেথ নামে। আফগানিস্তানের বিশাল এলাকাজুড়েই এখন মেথাম্ফিটামিনের চাষ হয়। অনেক এলাকায় আফিমের চেয়ে মেথাম্ফিটামিনের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। গবেষকদের অভিযোগ, আফগানিস্তানে অবৈধ মাদক বাণিজ্য বন্ধ করার ব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকার।
আর এখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশটিতে উৎপাদিত ভয়ঙ্কর মাদক মেথাম্ফেটামিন ইউরোপের জন্য বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ। তাদের আশঙ্কা ইউরোপের বাজারকে টার্গেট করে মাদকের উৎপাদন আরো বাড়বে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক মুখপাত্র আল জাজিরাকে বলেছেন, “জার্মান ফেডারেল পুলিশ পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। গত কয়েক বছর ধরেই আফগানিস্তানে বিশাল পরিমাণে মেথাম্ফেটামিন উৎপাদিত হচ্ছে। আর এই ভয়ঙ্কর মাদক হেরোইন চোরাচালানের পথ ধরে জার্মানি এবং ইউরোপের বাজারেও প্রবেশ করতে পারে।”
গবেষকদের আশঙ্কা, ইউরোপ এবং আন্তর্জাতিক বাজারকে টার্গেট করে আফগানিস্তানে মেথাম্ফেটামিনের উৎপাদন ব্যাপকহারে বেড়ে যেতে পারে।
আফগানিস্তানের পাহাড়ি এলাকায় জন্মানো বানদাক বা ওমান নামের এক ধরনের ঘাসজাতীয় গাছ থেকে এই ভয়ংকর মাদক সংগ্রহ করা হয়। আগে লোকে এই ঘাসজাতীয় গাছকে লাকড়ি বা জ্বালানি কাঠ হিসাবে ব্যবহার করত। কিডনির রোগের চিকিৎসায়ও এই ঘাসের ব্যবহার হতো বলে জানা যায়। আর এখন এই ঘাস বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা হচ্ছে ভয়ংকর মাদক উৎপাদনের জন্য।
মাদককে ঘিরে তালিবানের শক্তিবৃদ্ধি
বৈশ্বিক আফিম ও হেরোইন সরবরাহের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে আফগানিস্তান থেকে। বিপুল অংকের এ মাদক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ প্রধানত তালেবানদের হাতে। গত দুই দশকে তালেবানদের আয়ের এ উৎসে বারবার আঘাত হানার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও তাতে সামান্যতম সফলতাও আসেনি।
এখনও গোটা বিশ্বে আফিমজাত মাদকের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী তালেবানরাই। আফগানিস্তানে তাদের ক্ষমতা দখলকে ঘিরে পৃথিবীজুড়েই মাদক সমস্যা আরো মারাত্মক আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মধ্যেই আফগানিস্তানের আফিম বাণিজ্যের পরিমাণ দেশটির মোট জিডিপির ৬ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে দাঁড়ায়। ওই বছরেই আফগান মাদক বাণিজ্যের আকার দেশটির পণ্য ও সেবার বৈধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেও ছাড়িয়ে যায়।
একই দপ্তরের সাম্প্রতিক আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালেও আফগানিস্তানে পপি (আফিম) চাষ হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে। এরপর গত বছর দেশটিতে আফিম আবাদি এলাকার পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। ২০২০ সালে আফগানিস্তানে আফিম চাষ হয়েছে মোট ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দেশটি থেকে অবধারিতভাবেই বিশ্বব্যাপী আফিম ও হেরোইনের সরবরাহ বাড়তে যাচ্ছে।
মাদক ব্যবসা এখন আফগান অর্থনীতির প্রকৃত মেরুদণ্ড হয়ে উঠছে। ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তালেবানদের মোট আয়ের অর্ধেকই এসেছে মাদক ব্যবসা থেকে। এজন্য নারকোটিক ফসল উৎপাদন ও চাষাবাদ, এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং মধ্য এশিয়ার ভেতর দিয়ে অপরাধীনির্ভর সরবরাহ রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়েছে তাদের। এখন তাদের হাতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের এ প্রকৃত সুযোগকে কাজে লাগাবে তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৪৭
আপনার মতামত জানানঃ