বাউল গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জের কিশোর মেহেদী হাসান (১৬) বাউল গানে যোগ দেন। এই সময়ের অন্যান্য কিশোররা যখন আধুনিক শার্ট প্যান্ট পরে চলাচল করে মেহেদী হাসান নিজের এসমস্ত বেশভূষা ছেড়ে ধরেন বাউল পোশাক। বিভিন্ন স্থানে গুরুদের সাথে করতে থাকেন বাউল গান। কিন্তু মোল্লাতান্ত্রিক সমাজের গ্রাম্য মাতব্বররা বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারেননি। তাই বাউল মেহেদী হাসানকে মারধর করে মাথা ন্যাড়া করে গ্রাম ছাড়ার হুমকি দেন। মামলা করার পর পুলিশ তিন মাতব্বরকে গ্রেপ্তার করেছে।
গত শনিবার রাত ১০টার দিকে উপজেলার জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মেহেদী হাসানের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কিশোর থানায় মামলা করে। গতকাল মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামের মাতবর শাফিউল ইসলাম ওরফে খোকন (৫০), মেজবাউল ইসলাম (৫২) ও তারেক রহমানকে (২০) গ্রেপ্তার করেছে। মামলায় জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামের ফজলু মিয়া (৪০), আবু তাহের (৫৫) ও আরও দুজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা পলাতক রয়েছেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ছোটবেলা থেকে দাদা আলম মন্ডলের বাড়িতে থাকতো মেহেদী। অর্থাভাবে ষষ্ঠ শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করতে পারেনি। তাই বাউল গান শেখার জন্য শিল্পী মতিয়ার রহমান মতিন বাউলের সঙ্গে চলাফেরা করে। তাকে অনুসরণ করে বড় চুল (বাবরী) রাখে এবং অধিকাংশ সময় সাদা রঙের গামছা, ফতুয়া ও লুঙ্গি পরিধান করে মেহেদী। গান শেখার জন্য ওস্তাদ মতিন বাউলের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে যায় এবং সেখানে গান পরিবেশন করে। ওইসব অনুষ্ঠানে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে মেহেদী। অধিকাংশ সময় সাদা পোশাক পরিধান ও বাউল গান করায় তাকে ও ওস্তাদদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করতো আসামিরা।
বাউল মেহেদী হাসান তাদের এমন আচরণের প্রতিবাদ করায় মাতব্বররা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়। এর জেরে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে আসামিরা তার দাদার বাড়িতে প্রবেশ করে। খোকনের হুকুমে তাহের ও মেজবা তাকে চেপে ধরে এবং তারেক ও ফজলু মেশিন দিয়ে তার মাথা ন্যাড়া করে দেয়। মেহেদী চিৎকার করলে তাকে মারধর করা হয়। এ সময় ফজলু মিয়া বিছানায় বালিশের নিচ থেকে তার দেড় হাজার টাকা চুরি করে। মেহেদীর চিৎকারে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলে আসামিরা পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে তারা বাউল গান বন্ধ করতে বলে, অন্যথায় তাকে পিটিয়ে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দেয়।
মেহেদী হাসানের অভিযোগ, তাকে সমাজে হেয় এবং কোথাও যাতে যেতে না পারে সে জন্য তারা মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে।
বাউল শিল্পী মেহেদী বলেন, ‘অভিযুক্ত শফিউল ইসলাম খোকন অন্যদের বলে, ”শালার মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে বাউল গানের সাধ মিটিয়ে দে”। তখন চুল কাটা মেশিন দিয়ে জোর করে আমাকে ন্যাড়া করে দেয় ও মারধর করে তারা।’
‘অভিযুক্ত শফিউল ইসলাম খোকন অন্যদের বলে, ”শালার মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে বাউল গানের সাধ মিটিয়ে দে”। তখন চুল কাটা মেশিন দিয়ে জোর করে আমাকে ন্যাড়া করে দেয় ও মারধর করে তারা।’
শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, এটা নিছক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আবহমান বাংলার শিকড় সংস্কৃতির ওপর ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের আঘাত। মঙ্গলবার রাতে মামলার পরপরই অভিযান চালিয়ে তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সাধারণ কোনো অপরাধ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক সংস্কৃতির উপর এক বিরাট আঘাত।
তারা বলেন, মাটি, মানুষ, প্রকৃতি, জীবনবোধ, ধর্ম, প্রেম ও দেশের কথাই বেশিরভাগ সময় উঠে এসেছে বাউল সাধকদের কথায় গানে ও জীবনাচরণে। এর পাশাপাশি সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বাউলরা সকল সময়ে সোচ্চার থাকেন তাদের বাণী ও সুরে। আজ তাই এই তথাকথিত তুচ্ছ ঘটনাগুলোকে তুচ্ছ করে না দেখে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
আরও বলেন, সমাজে যখন অমানবিকতার দাপট চলছে এমন সময়ে বাউলদের কাছেই আমাদের যেতে হবে। তারাই সমাজের প্রকৃত শিক্ষক ও বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মানুষকে মানবিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। তাই আক্রান্ত বাউলের পাশে দাঁড়ানো সমাজের সচেতন অংশের নৈতিক দায়িত্ব।
অবশ্য যারা সমাজের ঘটনা দুর্ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগে সরকার বা বিশেষ দলের লাভক্ষতির হিসেব কষেন, যারা নিজেদের বিবেক ও হিতাহিত জ্ঞানকে সঁপে দিয়েছেন শাসকগোষ্ঠীর পদপ্রান্তে, তাদের কাছ থেকে নৈতিক অবস্থান গ্রহণের প্রত্যাশা করা যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৮
আপনার মতামত জানানঃ