২০১৮ সালে যাত্রা শুরুর পর সাধারণ মানুষকে বাজারের চেয়ে কম দামে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা নেওয়ার উদ্যোগ হিসেবে সাইক্লোন (পরবর্তী সময়ে টি-টেন নামকরণ) অফার দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে ইভ্যালির বিরুদ্ধে। সাত থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিলেও তাদের পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আগাম মূল্য পরিশোধ করা অনেক গ্রাহক এখনো পণ্য পায়নি। ইভ্যালি যেসব গ্রাহককে রিফান্ড চেক দিয়েছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় সেগুলোও বাউন্স হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালির বকেয়া ২০৫ কোটি টাকার ওপরে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের কাছে বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই লাখ সাত হাজার ক্রেতা পাবে ৩১১ কোটি টাকা। আর পণ্য সরবরাহকারী মার্চেন্টরা পায় ২০৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাকি ২৬ কোটি টাকা পায় অন্য খাতের গ্রাহক। ইভ্যালির হিসাব অনুযায়ী, দায়ের বিপরীতে এর চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
এদিকে ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তাদের মোট দায় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি টাকা। তাদের সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা।’
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘নানা পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে ২১৪ কোটি টাকা এবং গ্রাহক ও অন্যান্য কোম্পানির কাছে বকেয়া আছে ১৯০ কোটি টাকা।’
গ্রাহকদের সাথে শত শত কোটি টাকার প্রতারণা করেছে ইভ্যালি। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে বর্তমানে আছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা। সম্পত্তির মধ্যে আছে দুটি এসইউভি, অন্যান্য কয়েকটি মোটরযান ও সাভারে একখণ্ড জমি— যার দাম মাত্র ৭-৮ কোটি টাকা। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে— বাকী সব টাকা কোথায় গেল? উত্তর সন্ধানে গ্রাহকদের কাছ থেকে ই-কমার্স কোম্পানিটির অগ্রিম নেওয়া অর্থের সন্ধান শুরু করেছেন তদন্তকারীরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান শাখার ডেপুটি কমিশনার মো: আসাদুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ও চেয়ারপার্সন শামীমা নাসরিনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টসমূহ ও সম্পদের তথ্য পেতে ইতোমধ্যেই তারা হাইকোর্টে আপিল করেছেন।
তিনি জানান, হাইকোর্ট অনুমতি দিলে, বাংলাদেশ ব্যাংক, যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের রেজিস্ট্রারার, সিটি করপোরশনসমূহ ও অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে এসব তথ্য পাবে পুলিশ।
পুলিশের উপ-পরিদর্শক ও তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘টাকার সন্ধান জানতে আমরা রাসেল-নাসরিন দম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু তারা আমাদের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। এজন্যই আমরা এখন তাদের ব্যাংক হিসাবগুলোর তথ্য চেয়েছি’।
এদিকে পুলিশের বিশ্বস্ত একটি সূত্র টিবিএস’কে বলেছে, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময় রাসেল আমাদের বলেছেন, অনেক টাকা বিজ্ঞাপন ও প্রমোশনে খরচ করা হয়েছে। কিছু অংশ খরচ হয়েছে আকর্ষণীয় মূল্যছাড়ে’।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘কিন্তু, এসব খরচ বাদ দিলেও, বিপুল পরিমাণ টাকার এখনও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাহলে টাকা গেল কোথায়? বিষয়টি আমরা গুরুত্ব-সহকারে দেখছি’।
সূত্রটি আরও বলেছে, ‘বেশ কয়েক কোটি টাকা প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের সময় রাসেল তাদের নাম বলতে পারেননি। তবে তিনি বলেছেন, বিশাল রকমের মূল্যছাড়সহ সব প্ল্যান করেন শামীমা নাসরিন। রাসেল শুধু স্ত্রীর বুদ্ধি অনুসরণ করে দেশের ই-কমার্স খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি গড়ে তোলেন’।
এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গ্রাহকদের দেওয়া অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হলে ইভ্যালিসহ সকল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে না জেনে, মানুষজনকে লেনদেনে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েও সতর্ক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘বেশ কয়েক কোটি টাকা প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের সময় রাসেল তাদের নাম বলতে পারেননি। তবে তিনি বলেছেন, বিশাল রকমের মূল্যছাড়সহ সব প্ল্যান করেন শামীমা নাসরিন। রাসেল শুধু স্ত্রীর বুদ্ধি অনুসরণ করে দেশের ই-কমার্স খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি গড়ে তোলেন’।
তিনি বলেন, ‘লোভনীয় অফারের কথাই ধরুন, দামি যে গাড়ির দাম হয়তো ১০০ টাকা, তারা বলছে ৫০ টাকায় দেবে। তাই বিনিয়োগের আগে সবারই ভাবা উচিত, এক্ষেত্রে কতখানি ঝুঁকি রয়েছে এবং কী ধরনের পণ্য পাবেন। প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি, সেটাও ভাবতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করে যদি নিশ্চিত না হন, তাহলে এমন কোম্পানিতে আপনার বিনিয়োগ না করাই ভালো’।
টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়ার চর্চা ই-কমার্স খাতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করেছে বলেও মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, ইভ্যালির গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আপাতত ক্ষীণ। কারণে দেনা পরিশোধের মতো সম্পদ প্রতিষ্ঠানটির নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ছয় মাসের মধ্যে দেনা শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরণ করতে পারেননি প্রতিষ্ঠানের এমডি। গ্রেপ্তার হওয়া ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিষয়ে এখন আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন অথবা জনস্বার্থে এ কম্পানিতে ডেসটিনি, যুবকের মতো কাস্টডিয়ান দিতে পারেন।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘আমার ধারণা ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী গ্রেপ্তার না হলেও গ্রাহকরা টাকা পেত না, গ্রেপ্তার হয়েও গ্রাহকরা টাকা পাবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। টাকা পাবে কোথা থেকে, টাকা তো খরচ হয়ে গেছে কিংবা অন্যত্র চলে গেছে। যদি দিতে পারত তাহলে গত চার-পাঁচ মাস তিনি যে সময় নিয়েছেন সেই সময়ে টাকা ফেরত দিতে পারতেন। গত এক বছরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপকভাবে টাকা ঢেলেছে ইভ্যালি। স্পন্সরশিপ, বিজ্ঞাপন, প্রডাক্ট ডিসকাউন্ট, সেলিব্রেটিদের পকেটেও টাকা গেছে। দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে কি না তাও তদন্ত করে দেখা উচিত। প্রাইভেট লিমিটেড কম্পানির এমন ঘটনা ঘটলে নিয়ম হচ্ছে সম্পদ বিক্রি করে দেনা শোধ করা। ইভ্যালির যদি দেনার পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা হয়, তাদের সম্পদ বিক্রি করে ২০ কোটি টাকাও হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এটা নতুন ঘটনা নয়, আরো এক বছর আগে থেকে ঘটছিল। আমরা বিভিন্ন মহলে বলে আসছিলাম। আরো আগে পদক্ষেপ নেওয়া গেলে ক্ষতির পরিমাণ আরো কম হতো। গ্রাহক ও মার্চেন্টদের টাকা যা যাওয়ার চলেই গেছে। সরকার এই টাকার দায়িত্ব নিতে আইনগতভাবে বাধ্যও নয়। পি কে হালদারের প্রতিষ্ঠান, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকরা টাকা ফেরত পায়নি। ইভ্যালির গ্রাহক ও মার্চেন্টদের খুব আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখি না। যদি অনেক সম্পদ থাকত, ব্যাংকে টাকা থাকত তাহলে আইনগতভাবে কিছু পাওয়ার সুযোগ ছিল।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৬
আপনার মতামত জানানঃ