মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে প্রায় ছয় বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। দেশটির বিভিন্ন অংশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের যুদ্ধের আড়ালে আদতে লড়াই চলছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ওদিকে আবার সৌদি আরব ও ইরানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে ইসরায়েল। ইয়েমেনের হাউছি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবদুল মালিক আল-হাউছির দাবি, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের দেশগুলো গোপনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করছে। তারা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সৌদি আরবের শাসকরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট করেছে।
ইয়েমেনের দ্বীগগুলোতে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের আনাগোনা
তেহরানে নিযুক্ত ইয়েমেনের হাউছি সরকারের রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম মোহাম্মদ আল দাইলামি বলেছেন, ইয়েমেনের ভূমিতে ইসরায়েলিরা অবস্থান করছে। বিশেষ করে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইয়েমেনি দ্বীপগুলোতে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের আনাগোনা বেড়েছে। সম্প্রতি এমন সংবাদ প্রকাশ করেছে মিডলইস্ট মনিটর।
তেহরান টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইব্রাহিম মোহাম্মদ আল দাইলামি বলেন, ইসরায়েলিরা ইয়েমেনের আরব সাগরস্থ হানিশ, মায়ুন ও সুকোত্রা নামের দ্বীপগুলোতে অবস্থান করছে। তাদের এ ধরনের উপস্থিতি একসময় আর গোপন থাকবে না। ইয়েমেনের ভূমিতে তাদের এ সামরিক অবস্থানের বিষয়ে এ আগ্রাসী শক্তিগুলোর কোনো ধরনের লজ্জা নেই। এখন ইয়েমেন সরকারের প্রধান কাজই হচ্ছে দেশ থেকে বিদেশী সেনাদের বিতাড়িত করা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও ইসরায়েলসহ সকল আগ্রাসী শক্তিকে বিতাড়িত করা হবে।
ইয়েমেনের হাউছি সরকারের রাষ্ট্রদূতের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনের লাহজ প্রদেশের আল-আনাদ বিমানঘাঁটি নিয়ন্ত্রণ করছে। ইয়েমেনের মাহরা বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করেছে সৌদি আরব। এছাড়া তিনি আরো দাবি করেছেন যে ওমান সীমান্তের কাছে মাহরা প্রদেশে ব্রিটেনের সামরিক উপস্থিতিও দেখা গেছে। যদিও আরব আমিরাত সামরিকভাবে পরাজিত হচ্ছে তবুও তারা সুকোত্রা দ্বীপ, হাদরামৌত প্রদেশের মুকাল্লা বিমানবন্দর ও এডেন বিমানবন্দরের তাদের সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে।
সানাভিত্তিক ইয়েমেন সরকারের দাবি, আরব আমিরাত সুকোত্রা দ্বীপ ও বাব আল-মান্দেব প্রণালীতে সামরিক কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং অবৈধভাবে ইসরায়েলিদের (গোয়েন্দা) সুকোত্রা দ্বীপে প্রবেশ করতে দিচ্ছে।
ইয়েমেনের ভূমিতে ইসরায়েলিরা অবস্থান করছে। বিশেষ করে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইয়েমেনি দ্বীপগুলোতে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের আনাগোনা বেড়েছে।
আব্রাহাম অ্যাকোর্ড চুক্তির পর ইসরায়েল ও আরব আমিরাত তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। এখন তারা পরস্পরের মিত্র। এ দু’দেশ সুকোত্রা দ্বীপে গোয়েন্দা ঘাঁটি নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রস্তাবিত গোয়েন্দা ঘাঁটিটি দক্ষিণ ইয়েমেন থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে আরব সাগরে স্থাপন করা হবে। এ লক্ষ্যে ইসরায়েল ও আমিরাত প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ করেছে।
ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ ও ইরানের নৌ-চলাচল সম্পর্কে আগাম তথ্য জানতেই সুকাত্রাকে বেছে নিয়েছে এই দুই নয়ামিত্র।
দক্ষিণ ইয়েমেনের কূলঘেঁষা লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সংযোগস্থল বাব আল মান্দাব প্রণালী সংলগ্ন দ্বীপটি বর্তমানে আমিরাতের নিয়ন্ত্রণে। ওই অঞ্চল বসে শত্রু রাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও গতিবিধি নজরে রাখাই দুই দেশের মূল উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে লোহিত সাগরের বিমান চলাচলের দিকে নজর রাখবে ইসরায়েল ও আমিরাত গোয়েন্দা সংস্থা।
আমেরিকার কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনছে সৌদি আরব
আমেরিকার কাছ থেকে আরো সামরিক সরঞ্জাম কিনছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের কাছে ৫০ কোটি ডলারের হেলিকপ্টার রক্ষণাবেক্ষণের সরঞ্জামাদি বিক্রি করার অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। খবর রয়টার্স
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলায় জড়িতদের ব্যাপারে গোপন তথ্য প্রকাশ করার জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্দেশ দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এ সামরিক চুক্তির খবর এলো। চুক্তির খসড়াটি এখন পর্যালোচনার জন্য মার্কিন কংগ্রেসে পাঠানো হয়েছে।
সম্ভাব্য চুক্তি সম্পর্কে পেন্টাগন গত বৃহস্পতিবার বলেছে, সৌদি আরবের হেলিকপ্টারগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মূলত এই চুক্তির আওতায় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হবে। আমেরিকা সৌদি আরবকে ৩৫০ জন ঠিকাদার টেকনিশিয়ান সরবরাহ করবে। এছাড়া আমেরিকা দুইজন সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে যারা সৌদি আরবের অ্যাপাচি এবং অ্যাটাক হেলিকপ্টার রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নজরদারি করবেন।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম সৌদি আরবের সঙ্গে বড় ধরনের সামরিক চুক্তি হতে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কদিন আগেই ইরান সমর্থিত হুথিরা সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে বোমাবর্ষণ করে। তা অবশ্য সৌদি আরবের আক্রমণের জবাবেই। হুথিদের আক্রমণে সৌদি আরব অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে আফগানিস্তান হারিয়ে ইয়েমেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চাইছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে যেসব দেশকে চাপ দেবে যুক্তরাষ্ট্র
এদিকে শুক্রবার আব্রাহাম অ্যাকর্ড চুক্তির স্মরণে আয়োজিত সভায় জানানো হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বিভিন্ন দেশকে চাপ দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
খবরে বলা হয়, আরও আরব দেশকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উৎসাহিত করবে বাইডেন প্রশাসন।
আব্রাহাম অ্যাকর্ড হচ্ছে ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) কর্তৃক ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট সই করা একটি সম্মতিপ্রাপ্ত চুক্তি। ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় এ চুক্তি সই হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মরক্কোকে অনুসরণ করার জন্য আমরা আরও দেশকে উৎসাহিত করবো।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ বলেন, যে কোনো দেশ আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত গত বছরের সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ মাসে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়। এরপর বাহরাইন, সুদান এবং মরক্কো আরব আমিরাতের পথ অনুসরণ করে বর্বর রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।
বিনিময়ে ট্রাম্প প্রশাসন পশ্চিম সাহারার ওপর মরক্কোর কর্তৃত্বের স্বীকৃতি দেয়, সুদানকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকা থেকে বাদ দেয় এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই করে।
এদিকে ব্লিঙ্কেন ফিলিস্তিনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে ইচ্ছের কথা জানান, যা ট্রাম্পের প্রশাসনের সময় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং গাজার নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী হামাস কেউই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টিকে সেসময় ভালোভাবে নেয়নি। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টিকে ‘পিঠে ছুরি মারার’ সঙ্গে তুলনা করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৭
আপনার মতামত জানানঃ