ইভ্যালি বাংলাদেশ ভিত্তিক একটি ই-কমার্স প্লাটফর্ম। ক্যাশব্যাকের অফার দেওয়ার ক্ষেত্রে ইভ্যালির নাম উঠে আসে সবার আগে। লোভনীয় ডিসকাউন্টের ছিল ছড়াছড়ি। অল্প সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের ভোগান্তি শেষ সীমানায় পৌঁছেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। আর মোহাম্মদ রাসেল এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। মো. রাসেল ইভ্যালির সিইও, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন।
বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর একটি থানায় মামলা হয়। একই দিন বিকালে অভিযান চালিয়ে রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রপ্তার করে র্যাব।
বর্তমান হিসেবে ‘ইভ্যালি’ প্রায় ১৭ লাখ নিয়মিত ক্রেতা, ২০ হাজারের বেশি বিক্রেতা। এদের নিয়ে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে স্বল্প সময়ে প্রথম সারিতে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রিধারী মোহাম্মদ রাসেল হচ্ছেন ই-ভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা। কর্মজীবন শুরু করেন তিনি ঢাকা ব্যাংক দিয়ে। পরে ছেড়ে দিয়ে ‘কিডস’ ব্র্যান্ডের ডায়াপার আমদানি শুরু করেন। পরে নিয়ে আসেন ই-ভ্যালি। শুরুর দিকে চালু করা হয় ‘ভাউচার’ নামক একটি পদ্ধতি, এতে দেওয়া হতো ৩০০ শতাংশ ও ২০০ শতাংশ ক্যাশব্যাক। বর্তমানে ১৫০ শতাংশ, ১০০ শতাংশ এবং পরে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাকের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। শুরুর দিকে ১০ টাকায় একটি পেনড্রাইভ এবং ১৬ টাকায় টি-শার্ট বিক্রি করে সাড়া জাগায় ই-ভ্যালি।
ডিজিটাল ব্যবসার নতুন ফাঁদ ই–ভ্যালি
কিনলেই অর্থ ফেরতের অস্বাভাবিক ‘ক্যাশব্যাক’ অফার দিয়ে ব্যবসা করছে বাংলাদেশি ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালি। ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি অর্থ ফেরত দেওয়ার লোভনীয় এই অফারে হাজার হাজার গ্রাহক আকৃষ্ট হচ্ছেন। লাভবানও হচ্ছেন অল্প কেউ, বেশির ভাগই আছেন লাভবান হওয়ার অপেক্ষায়।
কার্যক্রম শুরুর দুই বছর পার না হতেই এ পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটি এক হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৫০ হাজার টাকা। ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে নানা অভিযোগও জমা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়ের ধরন দেখে বিশেষজ্ঞরাও আশঙ্কা করছেন, এতে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ রয়েছে।
অনলাইনে পণ্য কিনলে সময় বাঁচে, ঝক্কিও এড়ানো যায়। তাই ঘরের দুয়ারে প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নিবন্ধন নেয় ই-ভ্যালি। মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল ফোনসেট, টেলিভিশন ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি গাড়ি বিক্রিতেও নেমেছে।
ই-ভ্যালি জানায়, তাদের নিবন্ধিত গ্রাহক ৩৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মাসে লেনদেন হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকার পণ্য। ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রির বিপরীতে কর দেওয়া হয়েছে দেড় কোটি টাকা। গড়ে প্রতি মাসে পণ্য বিক্রির অর্ডার পাচ্ছে তারা ১০ লাখ করে। তাদের সঙ্গে এরই মধ্যে যুক্ত হয়ে পড়েছে ২৫ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এবং তারা ৪ হাজার ধরনের পণ্য বিক্রি করে কমিশন পাচ্ছে।
মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে শুরু করা এই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন এখনো ৫০ হাজার টাকাই। ২০১৮ সালের ১৪ মে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নেয় ই-ভ্যালি ডটকম লিমিটেড। এর অনুমোদিত মূলধন ৫ লাখ টাকা। ১০ টাকা মূল্যমানের এক হাজার শেয়ারের মালিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল। আর চার হাজার শেয়ারের মালিক তাঁর স্ত্রী ও কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন মোহাম্মদ রাসেল আর শামীমা নাসরিন দিয়েছেন ৪০ হাজার টাকা।
অভিনব বিক্রয় পদ্ধতি
প্রচলিত পদ্ধতিতে পণ্য কেনার সঙ্গে সঙ্গে দাম পরিশোধ করতে হয়। দেশে কিস্তিতে ও বাকিতে পণ্য কেনার সুযোগও তৈরি হয়েছে এখন। আর কয়েক বছরের প্রবণতা হচ্ছে অনলাইনে কেনাকাটা। সে ক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম পরিশোধ করতে হয়, যাকে বলা হয় ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’। কিন্তু ই-ভ্যালি এসব পথে হাঁটছে না। ই-ভ্যালি থেকে পণ্য কিনতে গেলেই দাম পরিশোধ করতে হয় আগে।
শুরুতে যে বলা হলো এক লাখ টাকার পণ্য কিনে এক থেকে দেড় লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়, ই-ভ্যালি এই ফেরতের নামই দিয়েছে ‘ক্যাশব্যাক’। ক্যাশব্যাক জমা হয় ই-ভ্যালি ব্যালান্সে। তা–ও আবার তিন দিন পর। এই টাকায় ই-ভ্যালি থেকেই অন্য পণ্য কিনতে হয়। সে ক্ষেত্রে পণ্যের ৬০ শতাংশ দাম গ্রাহক পরিশোধ করতে পারেন ব্যালান্স থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ পকেট থেকে টাকা দিতে হয়।
ই-ভ্যালির রয়েছে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ‘ভাউচার অফার’। আরও রয়েছে ‘ক্যাম্পেইন’ নামক একটি বিকল্প কর্মসূচি। ক্যাম্পেইনভেদে পণ্য সরবরাহ করা হয় ৭ থেকে ৪৫ দিনে। ই-ভ্যালি এ–ও বলছে, অনিবার্য কারণবশত ক্যাম্পেইনে যেকোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জনের সম্পূর্ণ অধিকার ই-ভ্যালি কর্তৃপক্ষের রয়েছে। তবে কিছু গ্রাহকের অভিযোগ হচ্ছে, বেঁধে দেওয়া সময়ে তারা পণ্য পাচ্ছেন না। আর ই-ভ্যালির জবাব হচ্ছে, স্টক থাকা সাপেক্ষে পণ্য দেওয়া হয়, এমনকি চাইলেই গ্রাহকেরা টাকা ফেরত নিয়ে যেতে পারেন।
ই-কমার্সের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিক পণ্য সময়মতো পৌঁছানো। কিন্তু ই-ভ্যালি অনেক ক্ষেত্রেই কাজটি করতে পারছে না। টাকা আটকে রেখে ই-ভ্যালি গ্রাহককে জানিয়ে দিচ্ছে, পণ্যের সরবরাহ নেই (স্টক আউট) বলে অর্ডার বাতিল করা হলো।
‘গিফট কার্ড’ নাম দিয়েও গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিচ্ছে ই-ভ্যালি। যারা গিফট কার্ড কিনছেন, তাঁরা তাদের টাকা ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।
পণ্য সরবরাহে ঘাটতি
ই-ভ্যালির আরেকটি বিষয় হচ্ছে ‘ই-ওয়ালেট’। ই-ভ্যালিতে পণ্য না পেয়ে অনেক সময় ক্রেতা যখন বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিল করে দেন, তখন তার টাকা জমা হয় ই-ওয়ালেটে। পণ্যের সরবরাহ না থাকায় ই-ভ্যালি নিজেও বাতিল করে দেয় অর্ডার। তখনো গ্রাহকের টাকা ই-ওয়ালেটে জমা হয়। টাকা আর ফেরত পান না গ্রাহক, বরং অন্য পণ্য কিনে উশুল করতে হয়।
উদাহরণ দিয়ে ই-ভ্যালির বঞ্চিত একজন গ্রাহক জানান, কেউ একজন আসুসের ল্যাপটপ কিনবেন বলে অর্ডার দিলেন। টাকাও জমা দিলেন। এক থেকে দুই মাস পর ই-ভ্যালি তাকে জানাল যে পণ্যটির সরবরাহ নেই। সরবরাহ আছে বেশি বেশি-দরের অন্য ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ। গ্রাহক সেটাই নিতে বাধ্য হন।
বিপুল পরিমাণ লোকসানে পণ্য বিক্রির ফলে ই-কমার্স ব্যবসায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে, যা অন্য কোম্পানিগুলোকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণে উৎসাহিত করবে। ফলে ভালো ও সৎ ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং এক সময় এইখাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে।
ই-ভ্যালির ওয়েবসাইটে ‘সাপোর্ট’ নামক একটি অপশন রয়েছে। এখানে ফোন করার ও ই-মেইলের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ফোন করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জবাব আসে, ‘আপনার বিষয়টি আমাদের টিম দেখছে। খুব শিগগির আপনাকে কল-ব্যাক করা হবে।’ অথবা বলা হয়, ‘একটু ধৈর্য ধরুন। খুব শিগগির আপনার পণ্যটি পেয়ে যাবেন।’
ইভ্যালির ই-ওয়ালেটের লাইসেন্স নেই
ই-ভ্যালি যে ওয়ালেট পদ্ধতিতে টাকা রাখছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সবিহীন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ৫ মার্চ দেশের সব তফসিলি ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) সেবাদাতা, পেমেন্ট সার্ভিস সেবাদাতা (পিএসপি) এবং পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরের (পিএসও) উদ্দেশে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বলেছে, কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়েই পিএসপি ও পিএসওর মতো কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা আইনসিদ্ধ নয়। কেউ প্রতারিত হলে গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট হবে এবং অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো ধরনের ওয়ালেটসেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইভ্যালি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সম্প্রতি ইভ্যালি ডট কম এর উপর পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ জন কর্মকর্তার একটি দল পাঁচদিন ব্যাপী এই পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালীর দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৩.৮০ কোটি টাকা, মাত্র ৬৫.১৭ কোটি টাকার চলতি সম্পদ দিয়ে কোন অবস্থাতেই কোম্পানিটি এই দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা নেই বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪ মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৩.৯৪ কোটি টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালী। অন্যদিকে, ইভ্যালী যেসব কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কিনে ওই সব মার্চেন্টদের কাছে কোম্পানিটির বকেয়া ১৮৯.৮৫ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, ইভ্যালির সকল চলতি সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬.১৪% পরিশোধ করা সম্ভব হবে এবং আরও ৩৩৮.৬২ কোটি টাকার সমপরিমাণ দায় অপরিশোধিত থেকে যাবে। ইভ্যালির চলতি সম্পদের স্থিতি দিয়ে শুধু গ্রাহক দায়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের দেওয়া ইভ্যালীর স্টেটমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল পজিশন অনুযায়ী, গত ১৪ মার্চ তারিখে প্রতিষ্ঠানটির মোট দায় (ইক্যুইটি বাদে) অপেক্ষা মোট সম্পদের ঘাটতি ৩১৫.৪৯ কোটি টাকা, চলতি দায় (ইক্যুইটি বাদে) অপেক্ষা চলতি সম্পদের ঘাটতি ৩৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ইভ্যালীর মোট সম্পদ প্রতিষ্ঠানটির মোট দায়ের মাত্র ২২.৫২% এবং চলতি সম্পদের পরিমাণ চলতি দায়ের মাত্র ১৬.০১%। কোম্পানিটির ১ কোটি টাকার শেয়ার মূলধনের বিপরীতে ২৬.৫১ কোটি টাকার স্থায়ী সম্পদ রয়েছে কিন্তু কোন দীর্ঘমেয়াদি দায় নেই।
মোট সম্পদ ও মোট দায়ের মধ্যে এ ধরণের অসামঞ্জস্যতা, চলতি দায় অপেক্ষা চলতি সম্পদের বিপুল ঘাটতি, চলতি দায় হতে স্থায়ী সম্পদ তৈরির প্রক্রিয়া কোম্পানিটির সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনার ত্রুটি নির্দেশ করে বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের কর্মকান্ডে সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, লোকসানে পণ্য বিক্রি করার কারণে ইভ্যালী গ্রাহক হতে অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পরও মার্চেন্টদের কাছে বকেয়া অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।
কী পরিমাণ পণ্যের অর্ডার ইভ্যালিও জানে না
ইভ্যালি থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ পণ্যের অর্ডার দেওয়া হয়েছে, তাতে জড়িত টাকার পরিমাণ কত— এটিই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর না জানে বাংলাদেশ ব্যাংক, না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, না আছে দুদকের কাছে। এমন কি খোদ ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও এই বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
গত ১৯ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইভ্যালিকে কারণ দর্শানো নোটিসে এসব তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি পাঠানোর পর প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোহাম্মদ রাসেল ওই চিঠির জবাবে তথ্য দিতে ছয় মাস সময় দাবি করে বলেছেন, প্রায় ৫ হাজারের বেশি মার্চেন্টের সঙ্গে তাদের হিসাব আছে। ডেলিভারিকৃত পণ্য গ্রাহক কর্তৃক পাওয়ার নিশ্চয়তার প্রমাণ, ত্রুটিপূর্ণ পণ্যের অভিযোগ, পূর্ববর্তী বিলের সমন্বয় করে মার্চেন্টের পূর্ণাঙ্গ হিসাব সম্পন্ন করার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। একটি তৃতীয় নিরপেক্ষ নিরীক্ষক দ্বারা সম্পূর্ণ আর্থিক হিসাব বিবরণী তৈরির পর ইভ্যালি সরকারকে তাদের লেনদেনের হিসাব জানাতে পারবে বলে জানিয়েছে।
সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, ইভ্যালির অর্ডার, লেনদেনের তথ্য দেওয়ার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংককেও সহায়তা করেনি। গত ১৪ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল ইভ্যালির কার্যালয়ে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য চাইলেও তারা তা দিতে সমর্থ হয়নি। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ইভ্যালি রেপ্লিকা ডাটাবেজ অনুসন্ধানের সুযোগ চাইলেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হয়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্চভিত্তিক প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা প্রতিষ্ঠানটির কাছে ১৫ জুলাইভিত্তিক লেনদেনের হিসাব জানতে চেয়েছি। ইভ্যালি জুলাই থেকে তাদের সাইক্লোন অফারটি বন্ধ করে দেয়। ফলে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেনদেন ও অর্ডারের তথ্য পেলে প্রতিষ্ঠানটির লাভ-লোকসান এবং পণ্য সরবরাহের সক্ষমতাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
জেনেশুনে নেতিবাচক কৌশল গ্রহণ করেন রাসেল : র্যাব
অনলাইনে পণ্য সরবরাহকারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল জেনেশুনে নেতিবাচক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন বলে জানিয়েছে র্যাব। আজ শুক্রবার এক ব্রিফিংয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ কথা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ব্যবসায়িক বিক্রি বাড়াতে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদা তৈরি হয় এ ধরনের পণ্যকে বেছে নেয় ইভ্যালি। যেমন— মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, এসি, মোটরবাইক, গাড়ি, গৃহস্থলীপণ্য, প্রসাধনী, প্যাকেজ ট্যুর, হোটেল বুকিং, জুয়েলারি, স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী ও ফার্নিচার ইত্যাদি। এসব পণ্যের মূল্য ছাড়ের ফলে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের বিশাল আকারে দায় (লায়াবেলিটিস) তৈরি হয়।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গ্রেপ্তার রাসেল ও তার স্ত্রীর ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল নতুন গ্রাহকের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পুরাতন গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের (লায়াবেলিটিস) অল্প অল্প করে পরিশোধ করা। অর্থাৎ ‘দায় ট্রান্সফার’ এর মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিল ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির নেটওয়ার্কে যত গ্রাহক তৈরি হতো, দায় (লায়াবেলিটিস) তত বাড়ত। গ্রেপ্তার রাসেল জেনেশুনে এ নেতিবাচক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ে এসব গ্রাহক সংগ্রহ করেছেন বলে র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন ইভ্যালির সিইও রাসেল।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ইভ্যালি প্রতিষ্ঠালগ্ন হতেই একটি লোকসানি কোম্পানি। কোনো ব্যবসায়িক লাভ এ যাবৎ করতে পারেনি। গ্রাহকদের থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই ইভ্যালি চলত। রাসেল তার কোম্পানির ব্যয়, বেতন, নিজস্ব খরচ নির্বাহ করতেন। ক্রমে ক্রমেই তার দায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল জানিয়েছেন, সাভারে তার ব্যক্তিগত কোটি কোটি টাকার সম্পতি রয়েছে। আর ইভ্যালির বর্তমান অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গেটওয়েতে ৩০-৩৫ কোটি রয়েছে, এই টাকাগুলো গ্রাহকদের।
গ্রেপ্তার রাসেল জানান, ২০২১ সাল পর্যন্ত ইভ্যালির দায় ছিল ৪০৩ কোটি টাকা, এর মধ্যে ইভ্যালির সম্পদ ৬৫ কোটি। এই বিপুল পরিমাণ দায়ের ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি রাসেল।
জিজ্ঞাসাবাদে এছাড়াও আরো অনেক ঋণ রয়েছে বলে জানান রাসেল। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ঋণে ডুবে আছে
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘ই-ভ্যালির কার্যক্রমের ধরন অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতো। এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, ই-ভ্যালিও তাই করছে। ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। কোম্পানির পরিচালকেরা সক্ষম হলে পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে পারতেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে মানি লন্ডারিং হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে দেখতে পারে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল পরিমাণ লোকসানে পণ্য বিক্রির ফলে ই-কমার্স ব্যবসায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে, যা অন্য কোম্পানিগুলোকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণে উৎসাহিত করবে। ফলে ভালো ও সৎ ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং এক সময় এইখাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে।
তারা বলছেন, গ্রাহক ও মার্চেন্ট এর বকেয়া ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এক সময় বিপুল সংখ্যক গ্রাহক ও মার্চেন্টের পাওনা অর্থ না পাওয়ার ঝূঁকি তৈরি হবে এবং এর ফলে সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাতে আস্থা ফেরাতে দোষীদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। যারা প্রতারণা করেছে, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই ধরনের প্রতারণা সামনের দিনে ঘটতেই থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ