করোনা ভাইরাসের মহামারির মধ্যেও ভারতে ধর্ষণ-গণধর্ষণ একটুও কমেনি বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও বেড়েছে। নারী নির্যাতনের দিক দিয়েও বেশ এগিয়ে ভারত। প্রতিদিন গড়ে ৭৭ জন নারী ধর্ষণ শিকার হচ্ছে। দেশটিতে প্রতিদিন গড়ে ৮০ জন খুনের শিকার হোন। গত তিন বছরে দেশটিতে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যার তীব্র বৃদ্ধি ঘটেছে। গত মঙ্গলবার ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-তে দৈনিক গড়ে ৭৭ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সবমিলিয়ে ২০২০-তে ২৮,০৪৬ ধর্ষণের ঘটনা নথিভূক্ত হয়েছে। নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ২০২০-তে আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমে হয়েছে ৩,৭১,৫০৩। ২০১৯-এ এই সংখ্যা ছিল ৪, ০৫,৩২৬। ২০১৮-তে এই সংখ্যা ছিল ৩,৭৮,২৩৬।
২০১৯-এর তুলনায় অপহরণ ও তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ২০২০-তে ১৯ শতাংশ কমেছে। ২০২০-তে অপহরণ ও তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো মামলার সংখ্যা ৮৪,৮০৫। এনসিআরবি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯-এ এই সংখ্যা ছিল ১,০৫,০৩৬।
রিপোর্ট অনুসারে, দিল্লিতে ২০২০-তে অপহরণ ও তুলে নিয়ে নিয়ে যাওয়ার মামলার সংখ্যা ছিল ৪,০৬২। রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০-তে ৮৪,৮০৫ টি অপহরণের মামলার শিকারের সংখ্যা ছিল ৮৮,৫৯০। এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৬,৫৯১ জন ছিল শিশু। বাকিরা প্রাপ্তবয়স্ক।
এদিকে দেশটিতে বৃদ্ধি পেতে থাকা ধর্ষণের ঘটনার জেরে মঙ্গলবার মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, প্রতিটি থানায় একটি ‘নির্ভয়া স্কোয়াড’ বা বিশেষ নারী নিরাপত্তা সেল গঠন করা হবে এবং যেসব এলাকায় নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের শঙ্কা বেশি সেখানে টহল জোরদার করা হবে।
এই স্কোয়াডে একজন নারী সহকারী পরিদর্শক বা উপপরিদর্শক, একজন নারী ও পুরুষ কনস্টেবল এবং একজন ড্রাইভার থাকবেন। প্রতিটি থানার একটি বিশেষ গাড়ি এই স্কোয়াডে যুক্ত করা হবে। টহল জোরদারে প্রতিটি থানায় নির্দিষ্টসংখ্যক পরিবহন দেওয়া হবে। এ ছাড়া স্কোয়াডের সদস্যদের দুই দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বস্তি, পার্ক, স্কুল, কলেজ, থিয়েটার ও শপিং মলের কাছাকাছি নির্জন এলাকাগুলোতে স্কোয়াড সদস্যদের উপস্থিতি থাকবে বেশি সময়।
প্রশাসনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন নারীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ থেকে অনেকেই ভয় পাবে এবং কমে আসবে নারী নির্যাতন।
২০১৯-এ এনসিবি-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী দৈনিক গড়ে ২০২০-র থেকে কম খুনের ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৯-এ গড়ে দৈনিক খুনের সংখ্যা ছিল ৭৯। ২০২০-তে এই সংখ্যা ১ শতাংশ বেড়েছে।
২০২০ সালে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৮০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে মোট ২৯ হাজার ১৯৩টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০-তে যে রাজ্যগুলিতে এ ধরনের অপরাধ সবচেয়ে বেশি দায়ের করা হয়েছে, সেগুলির মধ্যে প্রথম স্থানে উত্তরপ্রদেশ (১২,৯১৩)। এরপরই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ (৯,৩০৯), মহারাষ্ট্র (৮,১০৩), বিহার (৭,৮৮৯) এবং মধ্যপ্রদেশ (৭,৩২০)।
২০২০-এর রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৩ শতাংশ। তামিলনাড়ুতে ৪৪ শতাংশ, জম্মু ও কাশ্মিরে ২৮ শতাংশ, রাজস্থানে ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িষ্যায় অপরাধ বেড়েছে ২১ শতাংশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৬ টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে মাত্র ৯টিতেই শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং বিশেষ ও স্থানীয় আইনের অধীনে তালিকাভুক্ত এই ধরনের অপরাধের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নাম বেশ ওপরের দিকে। যদিও শীর্ষ তিনটি রাজ্যে গত তিন বছরে সব ধরণের অপরাধই হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে এই তালিকায় ওপরে উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নাম।
মধ্যপ্রদেশে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের ১৭ হাজার ৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এরপরেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, দায়ের হয়েছে ১৫ হাজার ২৭১টি মামলা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে মহারাষ্ট্র, সেখানে দায়ের হয়েছে ১৪হাজার ৩৭১টি মামলা। এরপরেই জায়গা পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে দায়ের হয়েছে ১০ হাজার ২৪৮টি মামলা।
পাশাপাশি এনসিআরবি-এর প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, গত বছর সাইবার ক্রাইম বেড়েছে ১১.৮ শতাংশ৷ ২০২০ সালে মোট ৫০ হাজার ৩৫টি সাইবার অপরাধের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে৷ এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল বা নকল খবর প্রকাশের অভিযোগও রয়েছে ৫৭৮টি৷ অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ৪ হাজার ৪৭টি ফ্রডের অপরাধ দায়ের হয়েছে৷ পাশাপাশি ওটিপি ফ্রড (১,০৯৩), ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড ফ্রড (১,১৯৪) এবং এটিএম অপরাধ (২, ১৬০)-ও রয়েছে৷ সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে রয়েছে কর্নাটক (১৬.২ শতাংশ), দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তেলেঙ্গানা (১৩.৪ শতাংশ), তৃতীয় স্থানে রয়েছে অসম (১০.১ শতাংশ), চতুর্থ স্থানে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (৪.৮ শতাংশ) এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে মহারাষ্ট্র (৪.৪ শতাংশ)৷ ২০১৯ সালে ৪৪ হাজার ৭৩৫ টি সাইবার অপরাধের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল৷ ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ২৭ হাজার ২৪৮৷
বিশ্ব মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভারত নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। অথচ মানবাধিকারসহ নানা সূচকে অনেক পিছিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর এই দেশটি। অন্তত সেদেশের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনআরসিবি) এই প্রতিবেদন পিছিয়ে থাকা ভারতকেই পরিচিত করছে বিশ্ব দরবারে। যদিও সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তাল ভারতে অপরাধের হার আরও অনেক বেশি বলে মত মানবাধিকারর্মীদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৬
আপনার মতামত জানানঃ