পানি দূষণের ফলে সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবহেলার কারণে জেলেদের মাছ ধরার যেসব জাল সাগরে ও সৈকতে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়, সেগুলোতে জড়িয়ে প্রতি বছর সাগরে ও নদীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন- ডলফিন, হাঙর, সামুদ্রিক কচ্ছপ, তিমি, কাঁকড়া ও সামুদ্রিক পাখির মৃত্যু হয়।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির তথ্যমতে, বাংলাদেশের জলসীমায় শুধুমাত্র এই জালেই ৬৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণির মৃত্যু হয়। গত দুই মাসে অন্তত ২৩টি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে। সারা দেশে কেবল জুলাইয়ে ১০টি ও আগস্টে ১৩টি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে
আগস্টে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় মুখে জাল জড়ানো অবস্থায় বেশ কয়েকটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। সাগরে জেলেদের ফেলে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় জালের অংশ মুখে জড়িয়ে শ্বাসবন্ধ হয়ে ডলফিনগুলোর মৃত্যু হয়েছে।
চলতি বছরের পহেলা আগস্ট চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী থেকে একটি ডলফিনের মরদেহ উদ্বার করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির টিম। উদ্ধারকালে মৃত ডলফিনটির মুখে জড়ানো ছিল জাল। এরপর ময়নাতদন্ত করে জানা যায়, ‘মুখে জাল জড়িয়ে শ্বাসনালী বন্ধ হওয়ায় ডলফিনটির মৃত্যু হয়েছে।’
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) হিসাবে, বাংলাদেশের জলসীমায় ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৫০টির মতো সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ডলফিন।
মৃত্যুর খতিয়ান
ডব্লিউসিএস-এর কান্ট্রি রিপ্রেজেনটিটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সমুদ্রে যেসব প্রাণির অকাল মৃত্যু হয়, এদের মধ্যে ডলফিনের সংখ্যা বেশি। এর মূল কারণ জেলেদের ফাঁস জাল। শুধুমাত্র এই জালেই ৬৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণির মৃত্যু হয়। এছাড়া বিহুন্দি জাল ও সমুদ্রে চলন্ত ফিশিং বোটের আঘাতও ডলফিনের মৃত্যুর কারণ।’
কুয়াকাটায় ডলফিন নিয়ে কাজ করছে ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টার। তাদের প্রকল্প ইকো ফিশ-এর প্রধান এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘মূলত আমাদের জেলেরা অসচেতনভাবে অনেক টুকরো জাল সাগরে বা নদীতে ফেলে দেন। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীও তাদের অপারেশনের সময় অবৈধ জালগুলো কেটে সাগরে বা নদী ভাসিয়ে দেয়। এইসব জাল সাগরে ভাসতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে এই জালগুলোতে শ্যাওলা জন্মে এবং বিভিন্ন ছোট ছোট মাছ ও শামুক বাসা বাঁধে। এগুলোকে দেখেই অবুঝ ডলফিন খাবার ভেবে খাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় ওই টুকরো জাল ডলফিনের মুখে ও দাঁতে জড়িয়ে তাদের শ্বাসরোধ করে ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে প্রাণীটির মৃত্যু হয়।’
‘মূলত আমাদের জেলেরা অসচেতনভাবে অনেক টুকরো জাল সাগরে বা নদীতে ফেলে দেন। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীও তাদের অপারেশনের সময় অবৈধ জালগুলো কেটে সাগরে বা নদী ভাসিয়ে দেয়। এইসব জাল সাগরে ভাসতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে এই জালগুলোতে শ্যাওলা জন্মে এবং বিভিন্ন ছোট ছোট মাছ ও শামুক বাসা বাঁধে। এগুলোকে দেখেই অবুঝ ডলফিন খাবার ভেবে খাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় ওই টুকরো জাল ডলফিনের মুখে ও দাঁতে জড়িয়ে তাদের শ্বাসরোধ করে ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে প্রাণীটির মৃত্যু হয়।’
ইকো ফিশ প্রকল্পের সহকারী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, ‘সমুদ্রে যে পরিমাণ ডলফিন মারা যাচ্ছে, তার সামান্য অংশ আমাদের চোখে পড়ে। ৭১০ কিলোমিটার উপকূলের মাত্র ১০ কিলোমিটারের তথ্যই যদি এমন ভয়ানক হয়, তবে পুরো উপকূলে কোন পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে তা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন আছে।’
ডব্লিউসিএস এর কান্ট্রি রিপ্রেজেনটিটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সত্যিকার অর্থে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ উপকূল ও দেশের নদীগুলোতে প্রতি বছর কী পরিমাণ ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে, তা কখনোই জানা যাবে না। কারণ, দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানই ডলফিনের মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ হিসেব রাখছেন না। এক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরগুলোর কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে।’
কী কারণে প্রতি বছর সাগর ও নদীতে এত ডলফিন মারা পড়ছে, তার কোনো সঠিক তথ্য নেই সরকারি দপ্তরগুলোর কাছে। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস বিভাগ ও বন বিভাগ পরস্পরের দিয়ে আঙুল তুলেই দায় সারছে!
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘ডলফিন স্তন্যপায়ী প্রাণী। আমাদের সোনাদিয়া উপকূল ও সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এলাকা অনেক আগে থেকেই ডলফিনের বিচরণক্ষেত্র। এরা যেহেতু বাতাসের অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকে, তাই পানির উপরিভাগে ডলফিনের বিচরণ। এ কারণে তাদের জালে আটকা পড়ার ঝুঁকি বেশি এবং আটকা পড়লে ডলফিনকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।’
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
পরিবেশবাদীরা বলছেন, সমুদ্র সৈকত এবং সংলগ্ন সাগর এলাকা লকডাউনের সময় কোলাহলহীন থাকায় ডলফিন, পরপয়েসের মত প্রাণী সৈকতের কাছাকাছি বিচরণ করছে। তাদের অধিকাংশের মৃত্যু ঘটছে মাছ ধরার জালে, জেলেদের অসচেতনতার কারণে।
সেইভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, ‘জেলেরা ডলফিনকে অনেক সময় টার্গেট করে। কারণ ডলফিন যেখানে থাকে সেখানে মাছ থাকে। তারা সমুদ্রের সেই অঞ্চলে জাল ফেলে, তখন ডলফিনও জালে আটকা পরে। তখন তারা বের হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে পাখনায় আঘাত পায়’।
‘আবার অনেক সময় জেলেরা তাদের জাল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। অনেক সময় লগির আঘাত ডলফিনদের মাথায় লাগে। ডলফিন খুবই স্পর্শকাতর প্রাণী। আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তাদের খুব কম। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা মারা যায়’।
তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাপারে জেলেদের সচেতন করতে হবে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী ১২টি সামুদ্রিক প্রাণী দেখভালের দায়িত্ব বন বিভাগের। কিন্তু তাদের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই’।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ পরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার মাঝেও অনেকে কিন্তু গোপনে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছেন। ডলফিনের মৃত্যুর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালে আটকে পরার ঘটনাই দায়ী’।
একই ধরনের মতামত দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান।
তিনি বলেন, “প্রধানত ডলফিন মারা যায় জালে আটকে। তাই জেলেদের ব্যাপকভাবে সচেতন করা ছাড়া বিকল্প নেই। আইন অনুযায়ী সাগরের প্রটেক্টেড এরিয়াগুলো দেখভালের দায়িত্ব বন বিভাগের। কিন্তু সেগুলো দেখভালের মতো লোকবল এবং অবকাঠামো তো নেই, ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। তাই শুধু ঘোষণা করলেই হবে না, সেগুলো রক্ষায়ও উদ্যোগী হতে হবে।”
অন্যদিকে তিমির মৃত্যুর কারণ জানতে ময়না তদন্তের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী।
তার মতে, অন্তত মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা গেলে একদিকে যেমন রেকর্ড থেকে যাবে, তেমনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা সহজ হবে।
ডব্লিউসিএসের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “যেহেতু বন বিভাগের লোকবল এবং অন্যান্য লজিস্টিকের সঙ্কট আছে তাই সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মৎস্য বিভাগ এবং কোস্টগার্ডের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। আরও বেশি মেরিন প্রটেক্টেড অঞ্চল গড়ে তোলা প্রয়োজন, বিশেষ করে সোনাদিয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে।”
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২২০০
আপনার মতামত জানানঃ