মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনী এবং জান্তাবিরোধী মিলিশিয়াদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজন শিশু রয়েছে। গত জুলাইয়ের পর সেনাবাহিনীর সঙ্গে এ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের যতগুলো সংঘর্ষ হয়েছে— শুক্রবারের এ সংঘাত সবচেয়ে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আজ শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়।
চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’ শুরুর ঘোষণা দেয় দেশটির ছায়া সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দুয়া লাসি লা। গত মঙ্গলবার ফেসবুকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় এই ঘোষণা দেওয়ার পর এটিই সবচেয়ে বড় সহিংসতার ঘটনা বলে সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে।
আলজাজিরা জানিয়েছে, মিয়ানমার ইস্যুতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অভ্যুত্থান-বিরোধী কর্মী এবং সামরিক বাহিনীর বিরোধী গ্রুপগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে শনিবার আহ্বান জানানোর পর সহিংসতার এই খবর সামনে এলো। দেশটিতে জান্তা সরকারের বিরোধীরা বলছেন, ‘দেশের বাইরে থেকে কার্যকর পদক্ষেপ বা হস্তক্ষেপের’ অভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।
স্থানীয় মিডিয়া ও একজন প্রত্যক্ষদর্শীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে মিয়ানমারের মাইয়িন থর গ্রামে নিহতের এই ঘটনা ঘটেছে। সেখানে সরকারি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন দেশটির ছায়া সরকারের অনুগত স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধারা। সংঘর্ষের সময় বার্মিজ সামরিক বাহিনী ব্যাপকভাবে কামানের গোলাবর্ষণ করলে স্থানীয় মিলিশিয়াসহ গ্রামবাসীরা নিহত হন।
এলাকাবাসী জানায়, শুক্রবার ভোরে ৪টি সামরিক গাড়িতে করে শতাধিক সেনা সদস্য মাইয়িন থর ও আশপাশের আরও পাঁচটি গ্রামে অভিযান চালায়। এ সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে পিপল ডিফেন্স ফোর্সের ব্যপক সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয়েছেন। এদের বেশিরভাগই তরুণ।
ঘরে তৈরি শিকারের বন্দুক ব্যবহার করে জান্তাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে চলেছে পিপল ডিফেন্স ফোর্সের সদস্যরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাইয়িন থরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার গ্রামের ২০ জনেরও বেশি লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’
সংঘর্ষের পর সৈন্যরা বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
প্রতিবেশী থর লিন গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, যুদ্ধের শব্দে স্থানীয়রা পালিয়ে স্থানীয় মঠ বা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে।
মাইয়িন থর গ্রামের ৪২ বছর বয়সী এক বাসিন্দা জানান, ‘সামরিক বাহিনী কামানের গোলা ছুড়ছে। আমাদের গ্রামের বাড়ি-ঘরও তারা পুড়িয়ে দিচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, নিহত ২০ জনের মধ্যে ৩ জন শিশুও রয়েছে। এছাড়া তার ১৭ বছর বয়সী ছেলেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন। তার ছেলে জান্তাবিরোধী মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য ছিলেন।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে ফোনে তিনি বলেন, ‘আমি সবকিছু হারিয়েছি… পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত আমি তাদেরকে ক্ষমা করবো না।’ সন্তানের মরদেহ চিহ্নিত করতে কার্যত সংগ্রাম করছেন বলেও জানান তিনি।
শনিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের গণ-অসহযোগ আন্দোলন জানিয়েছে, হাতের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়া ছাড়া মিয়ানমারের যুবকদের আর কোনো উপায় নেই। আর তাই ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)-র সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হতে জাতিসংঘসহ আসিয়ান দেশগুলোর প্রতি বিবৃতিতে আহ্বান জানানো হয়।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের নিয়ে এই সরকার গঠন করা হয়েছে এবং এর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন দুয়া লাসি লা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে। এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে।
চলতি বছরের ১ ফেব্রয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সন সুচিকে হটিয়ে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী এবং এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং। অং সান সুচি ও তার দল এনএলডির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা বর্তমানে গৃহবন্দি বা কারাবন্দি অবস্থায় আছেন।
পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স’র তথ্য অনুযায়ী, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০৫৮ জন নিহত হয়েছেন এবং ৬৩০০-র বেশি মানুষকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
জান্তাকে সাহায্য ঘোষণা চীনের
মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে বিভিন্ন প্রকল্পে সাহায্য করতে বিশাল অঙ্কের আর্থিক সহায়তার কথা ঘোষণা করেছে চীন। এ নিয়ে আজ দু’দেশের মধ্যে একটি মউ-ও সই হয়েছে। মিয়ানমারে চীনের দূত ওই মউ-এ সই করেছেন। নেপিদ-র চীনা দূতাবাসের ফেসবুক পেজে বিষয়টির সত্যতাও স্বীকার করা হয়েছে। খবর আনন্দবাজার
অর্থের অঙ্ক নেহাত কম নয়। মোট ৬০ লক্ষ ডলার। মিয়ানমারে মোট ২১টি উন্নয়ন প্রকল্পে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালতে চলেছে চীন। জান্তা সরকারের অ্যাকাউন্টে খুব শীঘ্রই পুরো অর্থ চলে যাবে বলে জানা যাচ্ছে। প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে পশুদের টিকা, কৃষি, বিজ্ঞান, পর্যটন, বিপর্যয় মোকাবিলা ও নানা ধরনের সাংস্কৃতিক লেনদেনের মতো বিষয়।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের পিছনে পড়শি চীনের একটা বড় সমর্থন রয়েছে বলে বরাবর অভিযোগ করে এসেছেন বিরোধীরা। এমনকি বিক্ষোভকারীদের দমন করতে জান্তা সরকারের হাতে চীন অস্ত্র তুলে দিচ্ছে বলেও একাধিক বার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু প্রতি বারই চীন সেই অভিযোগ নস্যাৎ করেছে। বরং বেইজিংয়ের দাবি, সেনা অভ্যুত্থান মিয়ানমারের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়। শুধুমাত্র আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে কূটনৈতিক পথে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ