এ বছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে অন্তত ৬৩ জন নারীর মরদেহ দেশে ফেরত এসেছে, জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকেই এসেছে ২২ জনের মরদেহ। লাশের এই মিছিল অনেকদিন ধরেই চলছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই হত্যা-নির্যাতন প্রতিরোধে এখনো জোরদার কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এখন পর্যন্ত সরকারপক্ষ সৌদি আরবের ওপর চাপ সৃষ্টিতে অনাগ্রহী। তারা বরং বলছেন, নিজেদের শুধরাতে হবে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের তথ্যমতে, চলতি বছরে দেশে ফিরেছেন প্রায় ৯০০ জন নারী। এর মধ্যে গত মাসে এক দিনেই ফিরেছেন ১০৯ জন গৃহকর্মী। সেখানে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা শারীরিক-মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১৯ সালে ফিরেছেন ১ হাজার ৩৫৩ জন নারী। সংস্থাটি জানায়, এদের মধ্যে অনেকে ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রয়েছেন।
অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরার ঘটনা থামছে না। বরং বাড়ছে আত্মহত্যার নামে মৃত্যুর সংখ্যাও। তবুও সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রেখেছে।
২০১৫ সালে গৃহকর্মী নিয়োগে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের হিসেবে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন ২ হাজার ২২২ নারী গৃহকর্মী। দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলেন, কাজের চাপ, দক্ষতার অভাব, ভাষা না জানা ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় টিকতে পারেন না নারী শ্রমিকরা। বাড়ি ফিরে যেতে সেখান থেকে পালিয়ে দূতাবাসের সেফ হোমে চলে আসেন। নির্যাতনের শিকার নারীরাও কখনো পালিয়ে আসেন কিংবা উদ্ধার হন। দেশে ফেরার অপেক্ষায় এখনো সেফ হোমে রয়েছেন অর্ধশতাধিক নারী কর্মী।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদিতে নারী কর্মী পাঠানোর আগে কাজের ধরন ও ভাষাগত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও তা মানা হয় না। উল্টো অবৈধভাবে পাঠানো দালালদের দৌরাত্ব বেড়েই চলছে। দালালদের আইনের আওতায় না এনে এখানেই দায় চাপানোর চেষ্টা করে সরকার। অনেকের মতে, গৃহকর্মী হিসেবে না পাঠিয়ে নারীদের অন্য কাজে পাঠানোর চেষ্টা করা উচিত। তবে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগে সৌদি সরকারের চাপ রয়েছে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বে করোনা পরিস্থিতিতে থমকে আছে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। সম্প্রতি দেশে ছুটিতে এসে আটকা পড়েন সৌদি আরব প্রবাসী প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিক। ভিসা-ইকামার নানা জটিলতা মিটিয়ে রাজপথে বিক্ষোভ করে অবশেষে ফিরছেন তারা। কর্মস্থলে ফিরতে যখন পুরুষ শ্রমিকদের তোড়জোড় চলছে, তখনও সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরছেন নির্যাতিত নারী শ্রমিক, কখনও তাদের মরদেহ। প্রায়ই বিমানবন্দরে দেখা যায় তাদের কারও শরীরে ক্ষত-বিক্ষত আঘাত, কেউ আসছেন ভাঙা পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশটি থেকে বাংলাদেশি গৃহশ্রমিকদের প্রত্যাবর্তন বন্ধ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করবে কিনা, স্টেটওয়াচের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন তোলা হয় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের কাছে। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, বিদেশে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারীদেরও কাজের সুযোগ বজায় রাখতে চায় সরকার। তিনি বলেন, সেখানে সবার অসুবিধা হচ্ছে না, অনেক নারী শ্রমিক ভালো আছেন এবং পরিবারের জন্য উপার্জন করছেন। নির্যাতিত নারী শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণসহ আইনি সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান মাসুদ বিন মোমেন। নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সরকারের দায় রয়েছে বলেও মনে করেন পররাষ্ট্রসচিব।
এই প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন-
[player id=1898]
সচিব বলেন, আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সির কারণেই হোক, আর যেমন করেই হোক, অনেক সময় দেখা যাচ্ছে অনেক অপ্রাপ্তবয়স্কও কিন্তু চলে যাচ্ছে। আমরা মৃত্যুবরণের খবরটা পাচ্ছি। কিন্তু অনেকে হয়তো মেন্টাল ট্রমার মধ্যে আছে, অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছে। এর জন্য কিছুটা হলেও আমরা নিজেরাও দায়ী। সেজন্য সৌদি আরবে মানুষ পাঠানোর সঙ্গে যারা জড়িত আছে, তাদের সবাইকেই সচেতন থাকা দরকার। কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।
সৌদিতে কাজ করতে গিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের জন্য সেখানকার সরকার ও সংশ্লিষ্ট নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকার কী করছে জিজ্ঞেস করা হলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, নিশ্চয়ই সৌদি আরবেও আইন কানুন আছে। সেখানকার আইন কানুনের সাহায্য নিয়ে আমাদের দূতাবাস প্রতিকার চাচ্ছে, ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করছে। সেখানেও আইনি প্রক্রিয়াতে আমরা অবশ্যই মনিটর করছি। তবে আমি মনে করি, সবার আগে আমাদের করণীয়গুলো আমরা পালন করছি কিনা দেখা উচিত। নিয়ম কানুন যেগুলো আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি তা পালনে আমাদের দিক থেকে যা কিছু করণীয় সেগুলো করা উচিত।
তবে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেনের মতে, সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সির দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে হবে। দূতাবাসের লোকবল ঘাটতি থাকায়, কমিউনিটি লেভেল থেকে নজরদারির উদ্যোগ নেয়া জরুরী। দেশ থেকে নারী শ্রমিকদের পাঠানোর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার পাশাপাশি কর্মস্থলে সদা নজরদারি নিশ্চিত করেই গৃহকর্মী পাঠানোর পরামর্শ তাঁর।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার প্রবাসী নারী শ্রমিকদের শ্রম অধিকার নিয়ে সৌদি সরকারের সঙ্গে কখনোই শক্ত লড়াইয়ে যায়নি। বিশাল শ্রমবাজারের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যক্তি শ্রমিকের সমস্যাকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের দিক থেকে চাপ না থাকায় সৌদি নিয়োগকর্তারা যা খুশি করার সাহস পাচ্ছে। একই কারণে সে দেশের সরকারও বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। এর আগেও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা প্রবাসে নারী শ্রমিকদের দুরবস্থাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আলাপ থেকে সরে গিয়ে উল্টো আমাদের করণীয় সামনে টেনে এনে এবার পররাষ্ট্র সচিবও সেই একই পথে হাঁটলেন।
[soliloquy slug=”man-power-10-days”]
সামিয়া/আরা/১১৫০
আপনার মতামত জানানঃ