ধর্মীয় গোড়ামি ও সামাজিক ট্যাবু ইত্যাদি নানা কারণে আক্রান্ত পরিবার একটি পরাধীন থাকার খাঁচায় পরিণত হয়ে আছে। আর যদি প্রসঙ্গটা হয় নারীর তবে সেখানে দ্বিতীয় কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে ধর্মীয় গোড়ামি ও সামাজিক ট্যাবুতে আক্রান্ত পরিবারের বিরুদ্ধে মামলায় লড়ে নিজের স্বাধীনতা আদায় করে নিয়েছেন যশোরের এক তরুণী। আদালতের নির্দেশে শেল্টার হোমে রাখা ২০ বছর বয়সের এক তরুণীকে নিজ জিম্মায় স্বাধীনভাবে থাকার অনুমতি দিয়েছে হাইকোর্ট।
তাকে শেলটার হোমে রাখতে যশোরের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দিয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে তিনি নিজ জিম্মায় থাকতে চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন। এই আপিল মঞ্জুর করে তাকে নিজ জিম্মায় থাকার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।
যশোর আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে করা আবেদন মঞ্জুর করে গতকাল মঙ্গলবার(৭ আগস্ট) বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আদালতে তরুণীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তাসমিয়াহ নুহিয়া আহমেদ।
আইনজীবী তাসমিয়াহ নুহিয়া আহমেদ জানান, ওই তরুণীর বাবা বিদেশে থাকেন। মা তাকে বিয়ে দিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন। কিন্তু বিয়েতে রাজি হননি তরুণী। এর মধ্যে তাকে একটি ঘরে প্রায় ২৬ দিন বন্দি অবস্থায় রাখা হয়। এক পর্যায়ে তিনি গত জানুয়ারি মাসে পালিয়ে ঢাকায় এসে একটি বুটিক হাউজে চাকরি নেন। এরপর বিয়ে না করলে তার মা তাকে হত্যা করবেন এমন অভিযোগ এনে বনানী থানায় ২৫ জানুয়ারি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
আইনজীবী তাসমিয়াহ বলেন, পরে ওই মেয়ের মা গত ২৩ মে যশোর আদালতে মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে একটি মামলার আবেদন করেন। যেখানে বুটিক হাউজের মালিকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
আদালতের আদেশে পিবিআই মেয়েটিকে যশোর আদালতে হাজির করে। গত ২৪ জুন জিম্মা নিতে মেয়ের মায়ের আবেদন এবং নিজ জিম্মায় থাকতে মেয়েটির করা আবেদন খারিজ করে দেন যশোরের আদালত। পাশাপাশি মেয়েটিকে সেফ হোমে পাঠানোর আদেশ দেন। সেই থেকে বেকুটিয়া শেল্টার হোমে আছেন ওই তরুণী।
এদিকে নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে নিজ জিম্মায় থাকতে হাইকোর্টে আবেদন করেন ওই তরুণী। শুনানির সময় ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট মেয়েটির বক্তব্য শোনেন। এরপর তার আবেদন মঞ্জুর করে মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) আদেশ দেন।
আইনজীবী তাসমিয়াহ নুহিয়া আহমেদ জানান, হাইকোর্টের এ আদেশের পর তরুণী নিজ ইচ্ছায় যেকোনও জায়গায় থাকতে পারবেন।
নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের এই আদেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘কোনো নারী স্বাবলম্বী হতে চাইলে সমাজের প্রতিটি স্তরে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়। আইনি প্রতিকার থাকলেও অনেকে তা জানেন না বা জেনেও সাহস করেন না। এ তরুণীর ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে উচ্চ আদালত, তা অনেক নারীকে সাহস জোগাবে। তাছাড়া আইনি প্রক্রিয়ায় নারীদের অধিকার নিশ্চিত হলে নারীর ক্ষমতায়ন আরও সুদৃঢ় হবে’।
‘কোনো নারী স্বাবলম্বী হতে চাইলে সমাজের প্রতিটি স্তরে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়। আইনি প্রতিকার থাকলেও অনেকে তা জানেন না বা জেনেও সাহস করেন না। এ তরুণীর ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে উচ্চ আদালত, তা অনেক নারীকে সাহস জোগাবে। তাছাড়া আইনি প্রক্রিয়ায় নারীদের অধিকার নিশ্চিত হলে নারীর ক্ষমতায়ন আরও সুদৃঢ় হবে’।
নথিপত্রে দেখা যায়, মেয়েটির জন্ম ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ঢাকার বনানী থানায় তার করা জিডির ভাষ্যমতে, মাসহ অন্যরা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিয়েতে তিনি অনীহা প্রকাশ করেন। এর জেরে তিনি গত ২০ জানুয়ারি ঢাকায় চলে আসেন। বনানীতে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকাকালে মাসহ অন্যরা তাকে মোবাইলে ভয়ভীতি ও হুমকি দেন।
অন্যদিকে, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মেয়েটির মা গত ২৩ মে চারজনের বিরুদ্ধে যশোরের আদালতে নালিশি মামলা করেন। এতে অভিযোগ করা হয়, তার মেয়েকে আসামিরা যেকোনো সময় দেশের বাইরে পাচার করে দিতে পারেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল নালিশি আবেদন তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
সেই সঙ্গে মেয়েটিকে উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। পরে মেয়েটিকে উদ্ধার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। গত ২৩ জুন মেয়েটি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মেয়েটি নিজ হেফাজতে থাকার আবেদন করেন। একই দিন মেয়েটিকে নিজ জিম্মায় চেয়ে আবেদন করেন তার মা।
গত ২৪ জুন ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়, নিরাপত্তার স্বার্থে ও কল্যাণার্থে মেয়েটিকে নিজ জিম্মায় না দিয়ে শেলটার হোমে রাখাই বলে যুক্তিযুক্ত মর্মে ট্রাইব্যুনালের অভিমত। পরে মেয়েটিকে শেলটার হোমে রাখা হয়।
হাইকোর্টে মেয়েটির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তাসমিয়াহ নুহিয়া আহমেদ। আদেশের পর তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর প্রায় আড়াই মাস ধরে মেয়েটি শেলটার হোমে আছেন। হাইকোর্টের আদেশের ফলে এখন তিনি নিজ জিম্মায় থাকার সুযোগ পেলেন।
পরিবারের বিরুদ্ধে লড়ে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করা তরুণীর সাহসিকতার প্রশংসা করছেন দেশের স্বাধীনতাকামী মানবাধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, প্রতিটা পরিবারেই নারী পরাধীন হয়ে থাকে। পিতা মাতাসহ পরিবারের সদস্যদের নিকট পরিবারের মেয়েটি একদিকে যেমন কখনো নিজের কথাটি বলতে পারে না তেমনি নিজের জীবন নিজেকে বেছে নেওয়ার অধিকারও পান না। সমাজের নির্ধারণ করে দেওয়া আজ্ঞাবহ পরিবারের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে প্রতিটা মেয়েকেই পরাধীন জীবন যাপন করতে হয়। যশোরের এই তরুণীর সাহসিকতা সেক্ষেত্রে অনুপ্রেরণাময় হয়ে থাকবে বলে জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ