সম্বোধন নিয়ে দেশের সাধারণ জনগণ প্রায়ই সরকারি দপ্তরগুলোতে দুর্ব্যবহারের শিকার হন। ‘স্যার’ সম্বোধন না করলে বিরক্তি ভাব দেখান কর্মকর্তারা। সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী, এ সহজ সত্যটি প্রচলিত না থাকার কারণে সাধারণ মানুষের সরকারি কর্মকর্তাদের স্যার ডাকার বাধ্যবাধকতা তৈরী হয়েছে।
একজন কর্মকর্তার আচরণের মধ্য দিয়ে সরকারের আচরণ প্রকাশ পায় মন্তব্য করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার আচরণ সরকারের আচরণ। আপনার আচরণ, আপনার অফিস, সাধারণ মানুষ মনে করে, এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একটি অংশ। অতএব, সে ক্ষেত্রে যাতে করে আমাদের কর্মকর্তারা এটি অবশ্যই মেনে চলে। স্যার, ম্যাডাম বা এমন কিছু বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোনো রীতি নেই।’
সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ ডাকার কোনো নিয়ম নেই মন্তব্য করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, রেগে কথা বলা, তিরস্কার বা দুর্ব্যবহার দুর্নীতির শামিল।
সচিবালয়ের গণমাধ্যম কেন্দ্রে মঙ্গলবার বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেসে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
জনগণের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সব সময় বলি, সেবা নিতে গেলে ওয়েলকামিং অ্যাটিচ্যুড না থাকলে, আপনি রেগে আছেন, তিরস্কার করছেন, এগুলো দুর্নীতি। আমি বারবার বলেছি, দুর্ব্যবহার দুর্নীতির শামিল। এটা করা যাবে না, কোনোভাবেই।’
সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাবলীলভাবে কথা বলার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কথা বলার অর্থ এই না আপনি আপনার ক্ষমতা দেখাতে পারছেন না। আপনি এখানে হেরে যাচ্ছেন, এমন কিছু না। আপনার অ্যাটিচ্যুড থাকবে আইনের মধ্যে থেকে সাধ্যমতো সেবা দিতে হবে।’
সেবা নিতে গেলে ওয়েলকামিং অ্যাটিচ্যুড না থাকলে, আপনি রেগে আছেন, তিরস্কার করছেন, এগুলো দুর্নীতি। আমি বারবার বলেছি, দুর্ব্যবহার দুর্নীতির শামিল। এটা করা যাবে না, কোনোভাবেই।’
স্যার না ডাকার জের ধরে অনেক সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। ইউএনকেও স্যার না ডেকে আপা ডাকায় কিংবা সরকারি অফিসে গিয়ে ভাই ডাকায় বিরক্ত হওয়া বা শাস্তি দেয়ার ঘটনা এ দেশে ঘটে এসেছে।
স্যার না ডাকায় স্বর্ণব্যবসায়ীকে মারধর
মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লাকে স্যার না ডেকে আপা ডাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে জরিমানার পর লাঠিপেটার ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী চন্দ্র দাশ (৪৫) উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের জায়গীর বাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী।
তখনকার চলমান কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনায় বের হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লা। জায়গীর বাজারে ফোর্স নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন তিনি। এ সময় ওই বাজারের প্রিতম জুয়েলার্স খোলা থাকায় দোকানটিতে ঢুকে মালিক তপন চন্দ্র দাস ও একাধিক ক্রেতাকে জরিমানা করেন। একপর্যায়ে দোকান মালিক তপনকে শাসানো হলে ইউএনওকে আপা বলে ক্ষমা চান তিনি। এরপর ইউএনও’র সঙ্গে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্য ওই ব্যবসায়ীকে লাঠিপেটা করেন।
ভুক্তভোগী তপন চন্দ্র দাস অভিযোগ করে বলেন, লকডাউনের শুরু থেকেই আমার দোকান বন্ধ ছিল। ক্রেতাদের চাপে আগের অর্ডার করা স্বর্ণালংকার বুঝিয়ে দিতে গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত উপস্থিত হয়। আদালত আমাকে দু হাজার টাকা জরিমানা করলে আমি পরিশোধ করি। লকডাউনে দোকান খোলা রাখায় ইউএনও আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন। আমি তাকে আপা বলে ক্ষমা চাই। এ সময় উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্য আমাকে লাঠি দিয়ে তিনটি বাড়ি মারে ।
সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুনা লায়লা বলেন, মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ওই দোকানে ১০ জন লোক ছিল, তাদের জরিমানা করা হয়েছে এবং দোকান বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আপা বলায় মারধর করা এ ধরনের ঘটনা সিনিয়র অফিসারদের কাছ থেকে হওয়া উচিত না।
‘অতএব সে ক্ষেত্রে যাতে করে আমাদের কর্মকর্তারা এটি অবশ্যই মেনে চলে। স্যার, ম্যাডাম বা এমন কিছু বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোনো রীতি নেই।’
কৃষি অফিসারকে ভাই সম্মোধন করায় সাংবাদিককে অপমান
মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাশকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করায় আপত্তি তোলেন তিনি। অনেক পরিশ্রম করে তাকে ‘এই চেয়ারে’ বসতে হয়েছে। তাই ‘ভাই’ না ডেকে তাকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে বলে জানান তিনি। আর তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করার মধ্যে তিনি অভদ্রতা খুঁজে পেয়েছেন।
শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে কৃষিবিষয়ক তথ্য জানতে গেলে স্থানীয় এক সাংবাদিক তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করায় এ বিব্রতকর বোধ করেন। কৃষি সম্প্রসারণ ওই কর্মকর্তা নিজেকে ‘স্যার’ ডেকে কথা বলতে বলেন।
তথ্য সংগ্রহ করতে যাওয়া ওই সাংবাদিক জানান, ঘটনার দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিবচরে বোরো ধান চাষ সম্পর্কে তথ্য আনতে তিনি অফিসে যান। কর্মকর্তার কক্ষে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে নিজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে ওই কর্মকর্তার কুশল জানতে চান। এ সময় তাকে ভাই বলে ডাকলে ক্ষেপে যান তিনি।
ওই সময় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ বলেন, আপনাদের ‘ভাই’ বলে ডাকার রেওয়াজ আর গেল না। জানেন, আমাদের এই চেয়ারে বসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
এরপর ওই সাংবাদিকের সঙ্গে কোনো কথা না বলে তাকে বসিয়ে রাখেন। ৭-৮ মিনিট পর ‘কী তথ্য লাগবে’ জানিয়ে অফিস সহকারীর সঙ্গে দেখা করতে বলেন তিনি।
বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার সাংবাদিক বলেন, আমি তো কোনো ব্যক্তিগত কাজে যাইনি। সংবাদ সংগ্রহে তথ্যের জন্য গিয়েছি। তাকে ভাই ডাকায় তথ্য দেয়ার পরিবর্তে তিনি ক্ষোভ ঝাড়লেন আমার ওপর।
শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাশের কাছে এ বিষয় ফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্যার বলা একটি ভদ্রতা। ভদ্রতা না করলে তাকে কী বলে বলেন? তাছাড়া তার কাজ তো করে দিয়েছি। এটা নিয়ে আবার কী হলো?
‘ভাই’ বলা কী ভদ্রতা নয়? জানতে চাইলে তিনি ফোন রেখে দেন।
মাদারীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, তার এটা বলার কথা না। যাই হোক, কিছু মনে করবেন না; আমি তাকে বলে দেব। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কাজ না করে। আমি বিষয়টি দেখছি। অল্প বয়স হলে যা হয় আর কী।
ইউএনওকে স্যার না বলায় শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেন ওসি
ইউএনও-কে স্যার না বলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেন নেত্রকোনা জেলা কলমাকান্দা থানার অফিস ইনচার্জ মাজহারুল ইসলাম। তিনি ওই শিক্ষার্থীকে ‘ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট হলো মাইগ্যা ডিপার্টমেন্ট, এখানে তো মাইগ্যারা পড়ে’ বলে মন্তব্য করেন। কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরবাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, ভবানীপুর এলাকার দুই বাড়িতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে লোকজন আসায় এলাকায় ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছিলো। এরপর এলাকা লকডাউন করার জন্য এলাকার লোকজন চেয়ারম্যানসহ নাজিরবাজার এলাকায় ইউএনওর কাছে অনুরোধ করেন। এসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এক শিক্ষার্থী ইউএনও-কে স্যার না বলায় তার উপর চড়াও হন কলমাকান্দা থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম। তিনি এসময় ওই শিক্ষার্থীকে জেরা করেন। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীর বিভাগ ‘ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট হলো মাইগ্যা ডিপার্টমেন্ট, এখানে তো মাইগ্যারা পড়ে’ বলে মন্তব্য করেন।
এমন ঘটনা দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের সামাজিক শিক্ষার দিকে আঙুল তোলে। প্রায়শই সাধারণ মানুষকে স্যার না ডাকা নিয়ে ভেগান্তির শিকার হতে হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন সরকারি আমলা রাষ্ট্রের কাজে নিয়জিত আমলা, যাদের কাজ দেশের জনগণের সেবা নিশ্চিত করা। সরকারি আমলাদের বেতনও হয় জনগণের টাকা থেকেই। সুতরাং একজন সেবাদানকারীকে হতে হবে নম্র, সহননীল। স্যার ডাকতে বাধ্য করা কিংবা স্যার ডাকার প্রচলনটি মূলত জনগণকে প্রজা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের রাজার আসন দেয়, বাস্তবে যা উল্টো হবার কথা। এবার এই প্রথার বিপরীতে স্রোত বওয়া উচিৎ।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২৩১৬
আপনার মতামত জানানঃ