গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা দেশে নতুন নয়। দেশের উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই অপরাধে জড়িত থাকার ঘটনা অহরহই উঠে আসছে খবরের শিরোনামে। এবার লালমনিরহাটের আদিতমারীতে পুলিশ সদস্য ও তার স্ত্রীর নির্যাতনের শিকার ৭ বছর বয়সী গৃহকর্মী শিশু।
জানা যায়, আজহার আলী সুমন নামে এক পুলিশ সদস্য ও তার স্ত্রী ডেইজি বেগমের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ওই শিশু গৃহকর্মী। হাসিনা নামে ৭ বছরের শিশুটি বর্তমানে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি।
নির্যাতনের শিকার হাসিনা বেগম লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের শিবরাম বলাইরহাটের হাছেন আলীর মেয়ে। সে আদিতমারী উপজেলার সঠিবাড়ি গ্রামে তার নানাবাড়িতে থাকতো।
নির্যাতনের শিকার শিশুর পরিবার ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এক বছর আগে আদিতমারী উপজেলার তালুক দুলালী গ্রামের হোসেন আলীর ছেলে পুলিশ পরিদর্শক আজহার আলী সুমন তার ঢাকার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে হাসিনা বেগমকে নিয়ে যান। এরপর থেকেই তাকে পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি বলে জানা যায়।
এর পাশাপাশি কারণে অকারণে শারীরিক নির্যাতন করা হতো শিশুটির উপর। দিনের পর দিন নির্যাতনে শিশু হাসিনা গুরুতর অসুস্থ হয় পড়লে রোববার (২৯ আগস্ট) একজন কনস্টবলের মাধ্যমে অসুস্থ শিশু হাসিনাকে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন ওই পুলিশ পরিদর্শক।
বাড়ি পৌঁছে সারা শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে নিজের ওপর হওয়া নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয় হাসিনা। পরে পরিবারের লোকজন তাকে ওই রাতেই লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।
শিশু হাসিনা বেগম বলে, টাঙ্গাইলের ওসি আজহার আলী সুমনের বাসায় কাজ করতাম। সেখানে কারণে অকারণে মারপিট করত, খুব কষ্ট দিতো তারা। বাড়ির কারো সঙ্গে কথাও বলতে দেয়নি। ব্যথার কারণে শরীরে হাত দিতে পারছি না।
লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. গোলাম মোর্শেদ দোলন বলেন, শিশু হাসিনার শরীরে পুরাতন ও নতুন আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে সে আশঙ্কামুক্ত।
আদিতমারী থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতনের খবরটি লোকমুখে ও ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। ভুক্তভোগী পরিবার থানায় এলে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জানা যাবে।
মূলত বাংলাদেশ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা। ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মোট ৪৪ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। ১২ জনের হয়েছে রহস্যজনক মৃত্যু, ধর্ষণের শিকার ১২ জন, শারীরিক আঘাত ও নিপীড়নের শিকার ১২ জন এবং নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মোট ১৩ জন গৃহকর্মী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত গৃহকর্মীদের মধ্যে তিনজনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন দুজন।
অথচ ২০১৫ সালে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা আইন অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। নীতিমালায় গৃহকর্মীদের সুবিধার জন্য হেল্প লাইন চালুসহ ১৪ বছরের নিচে কাউকে গৃহকর্মী নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তাদের শ্রমঘণ্টা এবং বেতন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করার মতো অধিকার নিশ্চিতের কথা বলা হয়। নীতিমালা অনুমোদন পাওয়ায় শ্রম আইন অনুযায়ী গৃহকর্মীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা। গৃহকর্মীদের নির্যাতন করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবে এমনটাই হওয়ার কথা।
কিন্তু গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় যখন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া হয়, তখন দেখা যায় দুই পরিবার সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মিটমাট করে ফেলে। তখন আর আইনের প্রয়োগ হয় না। তাই সামাজিক সচেতনতা ও নজরদারির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি চালিয়ে নিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০২৩
আপনার মতামত জানানঃ