বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই ই-কমার্স ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও, এই খাতটির ক্রমবর্ধবান গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের ভূমিকা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। যার ফলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর গোটা খাতটি এখন ভুগছে আস্থার সংকটে। সম্প্রতি খুব অল্প সময়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে।
শুরুতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে ‘অস্বাভাবিক’ সব অফার দেয়। পরে দেখা যায় যে অগ্রিম অর্থ নিলেও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তারা সময়মত পণ্য সরবরাহ করছে না। ভোক্তাদের অভিযোগ, পণ্যের টাকা পরিশোধ করা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে তারা পণ্য পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য সরবরাহকারী বা মার্চেন্টরা বলছেন, দিনের পর দিন তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে না। এই নিয়ে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শীতঘুমে কাটিয়েছে গোটা সময়টাই। আলোচনা আর আশ্বাসের বাইরে সমস্যা নিরসনে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
বাস্তবায়নহীন নীতিমালা ও শাস্তির অপ্রতুলতা
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে আস্থার জায়গা ধরে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করলেও, তা আছে মাত্র কাগজে কলমে। বাস্তবে এর কতোটা প্রয়োগ হচ্ছে তা নিয়ে নজরদারির যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
নতুন এই নির্দেশিকায় প্রধানত পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার কোন পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি-ম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি-ম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে।
এতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারি-ম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে ই-কমার্স কোম্পানি পণ্য মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না।
তবে নীতিমালা ভঙ্গ করলেও শাস্তিটা এক্ষেত্রে শুধু প্রশাসনিক; যেমন কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করা। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এমন অবস্থায় ই-কমার্সে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এসব নীতিমালার আলোকে শিগগিরই আইন প্রণয়ন করার কথা জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক এবং ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান। তবে কথা অব্দিই। আলোর মুখ দেখেনি কোন আশ্বাসই। কেবল নীতিমালা প্রণয়ন করেই দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন মন্ত্রণালয়। মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি।
অভিযোগ আর অস্বীকারের নীতি
স্বভাবতই নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন, ক্রেতাদের আস্থা ফেরাতে ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানালেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
একের পর এক চিঠি বা নোটিশ দিয়ে এবং দফায় দফায় বৈঠক করে নানাভাবেই এই প্রক্রিয়াকে বিলম্ব করা হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ।
তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কারণে ই-কমার্স সাইটে আগের চাইতে অনেক সুস্থ অবস্থা বিরাজ করছে। এখন আর প্রতারণার কোন অভিযোগ আসছে না। পাশাপাশি যাদের টাকা ও পণ্য আটকে আছে সেগুলো উদ্ধারে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
আরও জানানো হয়, আমরা চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি ডিসিপ্লিনের মধ্যে আনতে, যেন তারা প্রত্যেকের পাওনা আগে পরিশোধ করে। এবং কিভাবে সমস্যার সমাধান করবে সে বিষয়ে তাদের মতামত ও পরিকল্পনার কথা আমরা শুনছি।
তবে যেসব প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের পণ্য দিচ্ছে না বা মার্চেন্টদের পাওনা পরিশোধ করছে না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়া ছাড়া এই সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়।
এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ জানায়, আমরা গ্রাহকদের বলবো তারা যেন, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ দায়ের করেন বা ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করেন। আর যেসব মার্চেন্ট আছেন তারা যেন ব্যবসায়িক চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনে প্রচলিত আইনে আদালতে মামলা দায়ের করেন।
বাংলাদেশে এর আগেও এমন অবিশ্বাস্য অফার দেখিয়ে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। সে ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আগেভাগেই কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টররা জানান, তারা ধারণা করতে পারেননি যে এর মাধ্যমে দুর্নীতি, প্রতারণা, অস্বচ্ছতার আশ্রয় নেয়া হবে।
শুরুর দিকে বিষয়টা সেভাবে সামনে আসেনি। তাই কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তখন ভাবা হয়েছিল, ব্যবসার শুরুতেই যদি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় তাহলে ব্যবসার প্রসার থেমে যেতে পারে।
আগাম সতর্কতা নেই; অভিযোগের অপেক্ষায় কর্তৃপক্ষ
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি যথাযথ নীতিমালার মধ্যে থেকে কাজ করতে বাধ্য করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা আর নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবেই গ্রাহকদের এই ভোগান্তি। আগাম কোনো সতর্কতা ছিল না। ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ ওঠার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত মাসে কোম্পানিগুলোর ব্যবসা পদ্ধতি জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়।
গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সুরক্ষা এবং ডিজিটাল কমার্স খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধের লক্ষ্যে তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সেটাও জানতে চাওয়া হয়। এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের মোট সম্পদ ও দেনার পরিমাণ সেইসঙ্গে কতজন গ্রাহকের কি পরিমাণ টাকা আটকে আছে সে বিষয়ে জানিয়েছে।
দোসরা সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যবসা পদ্ধতি এবং কিভাবে তারা তাদের দেনা পরিশোধ করবে, সে বিষয়ে একটি গাইডলাইন দেবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে।
সেটার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও (বিএফআইইউ) অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও প্রচুর অভিযোগ জমা পড়েছে।
বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের কার্ডের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। পণ্য সরবরাহকারী বেশকিছু প্রতিষ্ঠানও এখন এসব কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-কমার্সে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো গ্রাহকের আস্থা। তা রক্ষা করা না গেলে তাতে দু-একটি প্রতিষ্ঠান নয়, গোটা শিল্পের ওপরই মানুষ আস্থা হারাবে। সে জন্য যেসব অভিযোগ আসছে, প্রশাসনিকভাবেই সেগুলো দ্রুত খতিয়ে দেখা দরকার। কেবল ভোক্তার স্বার্থেই নয়, বরং ই-কমার্স খাতের শৃঙ্খলা আনয়নে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দু-একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা কারও কাম্য নয়। ভোক্তা যাতে প্রতারিত না হন, বাজারে যাতে প্রতিযোগিতা থাকে বা সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান সুযোগ থাকে, সে জন্য এ খাতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা যথাযথ পরিচালন নীতিমালার দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬৪২
আপনার মতামত জানানঃ