মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর এ দেশে রোহিঙ্গার ঢল নামে। এসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নেন উখিয়া-টেকনাফের বনভূমিতে। সেখানে গড়ে তোলেন বসতি। এর পর থেকে উজাড় হতে থাকে বনসম্পদ। বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী ও পাহাড়। দখল হয়ে গেছে শ্রমবাজার, হুমকির মুখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বর্তমানে বহুমাত্রিক সমস্যায় স্থানীয়রা। রোহিঙ্গাদের কারণে নিজেদের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন এ দুই উপজেলার স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, আশ্রয় পাওয়ার পর বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা এমন আচরণ করছে যেন তারাই এখানকার স্থানীয়। কৃষি জমি, স্থানীয় শ্রমবাজার চলে যাচ্ছে তাদের দখলে। এতে উখিয়া ও টেকনাফসহ আশপাশের স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গারা। একে একে ৪টি বছর পার করেছে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের এসব নাগরিক। কিন্তু এখনো পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা যায়নি।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে দিন দিন টেকসই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বসবাস। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, বাজার ও মাদক নিয়ন্ত্রণে জড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও খুনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। স্থানীয়দের দাবি; প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় রোহিঙ্গারা ভুলে যেতে বসেছে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার কথা। ফলে রোহিঙ্গাদের কারণে নানাবিধ সমস্যায় উদ্বেগ বাড়ছে তাদের।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে প্রথমদিকে যে মনোভাব স্থানীয়রা পোষণ করেছিল, এখন তা আর নেই। আশ্রয় নেয়ার চার বছর পরও তারা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ায় টেকনাফ-উখিয়ার বাসিন্দারা হতাশ। ২০১৭ সালের আগস্টে ওই রোহিঙ্গা ঢলের সময় স্থানীয় যারা নিজ জমি ও বাড়িতে এসব মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তারা এখন নিজেদের জমিজমা হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন।
কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফে দেখা গেছে, রিকশা, অটোরিকশা, মাহিন্দ্রসহ বিভিন্ন গাড়ির চালক, খাবার হোটেল, আবাসিক হোটেল, গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে, জেলেদের ফিশিং বোটে ও ব্যবসা বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য কাজ এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ টেকনাফের স্থলবন্দরের অভ্যন্তরেও রোহিঙ্গারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে।
শুধু উখিয়া বা টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহরেও রোহিঙ্গাদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে দেখা গেছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানান, স্থানীয়দের চেয়ে রোহিঙ্গারা স্বল্প বেতনে কাজ করে। তাই তারা রোহিঙ্গা শ্রমিকদের কাজে নেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে টেকনাফ ও উখিয়ায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। আগে যে সবজি ২০-৩০ টাকায় কেনা যেত, এখন সেটি কিনতে হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। যাতায়াত খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ। আগে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে অটোরিকশা ভাড়া নিত ২৫০-৩০০ টাকা, এখন গুণতে হচ্ছে ৬০০-৭০০ টাকা। বাসেও দিতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।
উখিয়ার জামতলা ক্যাম্পের মোড়ে মোড়ে বাজার। সেখানে মিলছে কাঁচাবাজার, জুয়েলারি, ইলেকট্রনিকস পণ্য, জামা-কাপড়, জুতা, ওষুধ, জ্বালানি কাঠ, গ্যাসের সিলিন্ডার, দা-বটি-কুড়ালের মতো ধারালো অস্ত্রও। বাজার ঘুরে দেখা যায়, সেখানকার অন্তত ৪০ ভাগ পণ্য মিয়ানমারের। বাকি পণ্যের অর্ধেক বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া ত্রাণসামগ্রী— যা নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হওয়ায় বিক্রির জন্য দোকানে তুলেছে রোহিঙ্গারা।
চাষের জমি নিয়ে স্থানীয়দের উদ্বেগ
বালুখালী এলাকার মৌলভী গফুর উল্লাহ জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক চিন্তা করে নিজের জমিতে আশ্রয় দিয়েছিলাম। বর্তমানে জমির মালিক বলে দাবি করতে পারছি না। রোহিঙ্গাদের কথায় ক্যাম্প প্রশাসন আমাদের ২০ একর জমি দখল করে এনজিওদের ভাড়া দিয়েছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সব দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন বলে তিনি জানান।
ক্যাম্প লাগোয়া পশ্চিমপাড়া এলাকার কৃষক জমির আহমেদ বলেন, ক্যাম্পের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল, পচনশীল ময়লা, মানব বর্জ্যসহ নানা বর্জ্যে অতিষ্ঠ আমরা। কোনোভাবেই এ বর্জ্য ফেলানো ঠেকানো যাচ্ছে না। ১৫০ একর ধানি জমি চার বছর ধরে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে গেছে বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কুতুপালং এলাকার রহিম উদ্দিন নামে এক কৃষক বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আসার পর থেকে ধান চাষ বন্ধ রয়েছে। অথচ এ জমি আমাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু গেল চার বছরে ধান চাষ বন্ধ থাকায় লোকসানের মুখে পড়েছেন তারা।
২০১৭ সালের আগস্টে ওই রোহিঙ্গা ঢলের সময় স্থানীয় যারা নিজ জমি ও বাড়িতে এসব মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তারা এখন নিজেদের জমিজমা হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন।
উখিয়ার পালংখালীর স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জমি, ক্ষেতের ফসল সব দখল করে নিয়েছে। সংরক্ষিত বনের পাশে দুই একর জমিই ছিল আমার জীবিকার প্রধান অবলম্বন। এ জমিতে ধান ও সবজি চাষ করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুখে ছিলাম। এখন রোহিঙ্গারা সেই সুখ কেড়ে নিয়েছে। দুই একর জমির পুরোটাই রোহিঙ্গাদের দখলে। আমার মতো আরো অনেকের জমি রোহিঙ্গারা দখলে নিয়েছে।
বিলুপ্তির পথে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য
এ সময়ে বন্যপ্রাণীর অভ্যয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত উখিয়ার মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, ময়নারঘোনা, টিভি রিলে কেন্দ্র, তাজনির মারখোলা, শফিউল্লাহ কাটায় রোহিঙ্গা বসতির কারণে এ অঞ্চলে বসবাসরত এশিয়া প্রজাতির বন্যহাতি বিলুপ্তপ্রায়। একসময় ওই অঞ্চলে আড়াইশর বেশি বন্যহাতির অবস্থান থাকলেও ইতোমধ্যে তারা নিরাপদ বাসস্থান হারিয়ে অন্যত্রে পাড়ি জমিয়েছে। একসময় চট্টগামের দোহাজারি ও চুনতি রেঞ্জে উখিয়ার পাহাড়ি বনভূমিতে ঘুরে বেড়াত এশিয়া প্রজাতির ইন্ডিয়া উপপ্রজাতির হাতিগুলো।
আইইউর তথ্যমতে, কক্সবাজারের উত্তর-দক্ষিণ বনভূমিতে ৪৬-৭৮টি বন্যহাতির বিচরণ ছিল। কিন্তু এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে। বর্তমানে উজাড় হওয়া বন ও পাহাড়ে গড়ে উঠেছে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসতি। এতে বিলুপ্তির পথে বসেছে বন্যহাতিসহ বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য।
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির অষ্টম সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে। পুরনো দুটি নিবন্ধিত ক্যাম্প এবং নতুন অনিবন্ধিত ৩২টি ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গাদের মোট ক্যাম্প ৩৪টি।
ছয় হাজার ১৬৪ দশমিক দুই একর বনভূমি দখল করে এসব ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। এতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, ভূমিরূপ পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় এবং মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজ সম্পদের ক্ষতি টাকার অঙ্কে প্রায় ৪৫৭ কোটি টাকা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি প্রায় এক হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। মোট ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
এতে আরও বলা হয়, ৫৮০ একর সৃজিত বন এবং এক হাজার ২৫৭ একর প্রাকৃতিক বনসহ ক্যাম্প এলাকার বাইরে জ্বালানি সংগ্রহে রোহিঙ্গারা বনাঞ্চল উজাড় করেছে এক হাজার ৮৩৫ একর। সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণে মোট ধ্বংসপ্রাপ্ত বনের পরিমাণ ৮০০১ দশমিক ০২ একর এবং সর্বমোট বনজদ্রব্য ও জীববৈচিত্র্যসহ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের স্থানীয়দের মাঝে বেড়েই চলেছে সমস্যা। রোহিঙ্গারাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। এতে উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। কক্সবাজার ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন কোনো না কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, যতই দিন যাচ্ছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও অনিয়মতান্ত্রিক কাজে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
গতকাল শুক্রবার ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গা ইয়াছমিন আরা নামে এক নারী তার সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে উখিয়ার ১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইস্ট, ব্লক এ/৩-তে অবস্থিত তার মায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। জানা যায়, ইয়াছমিন আরার স্বামী মালয়েশিয়া থাকে।
বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের মরিচ্যা যৌথ চেকপোস্টে নোহা গাড়ি তল্লাশি করে মো. রাশেদ ইসলাম ও রোহিঙ্গা মো. আ. মালেক নামে একজনকে ৩০ হাজার ইয়াবাসহ আটক করেছে বিজিবি। তার বিরুদ্ধে রামু থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে।
একইদিন টেকনাফের ২৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আব্দুর রহমানকে ৬১ ইয়াবাসহ আটক করে এপিবিএন পুলিশ। তাকে টেকনাফ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
কক্সবাজার উখিয়ার ১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক সি/৭ এর বাড়ি থেকে ৯ হাজার ৬০০ ইয়াবাসহ আব্দুল হাবিবকে আটক করে এপিবিএন পুলিশ। তার বিরুদ্ধেও আইনি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
এদিকে, বৃহস্পতিবার টেকনাফের ২১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার সক্রিয় অপারেশনাল কিলার মো. হারেসের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন আরসার সদস্য একই ক্যাম্পের ব্লক: সি/৪ এলাকায় অস্ত্রসহ মহড়া ও এক রাউন্ড ফায়ার করে। এ ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি ও আতংকিত রয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া গত বৃহস্পতিবার উখিয়ায় ১১ ও ১২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভাসানচর থেকে নুর জাহান এবং রুহুল আমিন, তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে দুই রোহিঙ্গা পরিবারের মোট পাঁচজন পালিয়ে নিজ ক্যাম্পে চলে এসেছে বলে জানা গেছে।
এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, কক্সবাজারে গত দুই বছরে ২০০০ রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই মাদক, চোরাচালান, নারী পাচার ও অস্ত্র ব্যাবসার সাথে জড়িত। তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য শিবিরের ভেতরে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ক্যাম্পের বাইরে ওয়াচ টাওয়ারের কাজ চলছে। বর্তমানে সেখানে ৩ ব্যাটালিয়ন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে ৩৪টি ক্যাম্পের দায়িত্বে।
স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া উখিয়ার রাজাপালং ও পালংখালি ইউনিয়ন, টেকনাফের হোয়াইক্যং, হ্নিলা ও বাহারছড়া ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ লোক এখন চরম বিপদের মধ্যে রয়েছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গারা সহিংস হয়ে উঠছে। কথায় কথায় তারা স্থানীয় লোকজনের ওপর চড়াও হয়। রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ করলেও তাদের পুলিশে দেওয়া যায় না। তাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছেন স্থানীয়রা।
বিশ্লেষকদের মতামত
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সন্ধ্যা হলেই পুরো রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা দিনের বেলাতেও রাজ্যের বেশ কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাদের তুমুল লড়াই হয়েছে। সেনা শাসন শুরুর পর রাখানাইনে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কম। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরাকান আর্মির মনোভাব কী, সেটি জানাও এখন গুরুত্বপূর্ণ।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চার বছর পূর্তিতে এসে এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো শুরুর কোনো সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। মিয়ানমারের সামরিক শাসন,আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় থাকার পর এ অঞ্চলসহ ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে এখন আর নেই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে এখন রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে জোর দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সংকট দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি—বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সামনে নিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশকে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য এককভাবে চীনের ওপর নির্ভর না করে জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন পক্ষকে সঙ্গে নিতে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দরকার। প্রত্যাবাসন এবং রাখাইনে গণহত্যার জবাবদিহি নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের উদ্যোগে বাংলাদেশের সক্রিয় যুক্ততা জরুরি।
কূটনীতিকেরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার পৃথকভাবে জাতিসংঘের সঙ্গে দুটি চুক্তি সই করেছে। এর মধ্যে মিয়ানমার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিকে (ইউএনডিপি) যুক্ত করে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও জাতিসংঘ সেখানে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য কয়েকটি প্রকল্প নিয়েছে।
কূটনীতিকেরা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের প্রতি যতটা যৌক্তিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা উচিত, সেটি তারা করছে না। বরং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানা পরামর্শ দিচ্ছে। কক্সবাজারের শিবির থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরে বাংলাদেশের উদ্যোগকে প্রথমে ভালোভাবে নেয়নি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এখন আবার তারা বলছে, কক্সবাজারেও ভাসানচরের মতো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এটা মোটামুটি স্পষ্ট, লম্বা সময়ের জন্য রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থেকে যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ