
আট লক্ষ বছরের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্বের পরিমাণ সর্বোচ্চ রেকর্ড করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ওসানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নোয়া) প্রতিবেদনে সম্প্রতি এই তথ্য উঠে আসে। পাশাপাশি আইপিসিসি’র প্রতিবেদনে জানা গেছে, আর কয়েক বছরের মধ্যেই তীব্র তাপে পুড়তে শুরু করেছে পৃথিবী। বাড়বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে পৃথিবী।
গ্রিন হাউজ গ্যাসের রেকর্ড বৃদ্ধি
নোয়ার সাম্প্রতিক এই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪১২.৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) রেকর্ড করা হয়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় এই মাত্রা ২.৫ পিপিএম পর্যন্ত বেশি।
বিজ্ঞানীদের মতে, রেকর্ড তথ্য ও পর্যবেক্ষণ অনুসারে এখন পর্যন্ত বাতাসে এটি কার্বন ডাই অক্সাইডের সর্বোচ্চ মাত্রা।
আশির দশকেও বছরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের গড় বৃদ্ধি ছিল মাত্র ১.৬ পিপিএম। অথচ একাধিক জলবায়ু চুক্তি আর অসংখ্য পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনের তৎপরতার পরও গত ১০ বছরে ২.২ পিপিএম গড়ে বাড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইড!
যদি এ গ্যাসের বৃদ্ধি বর্তমান গতিতেই চলমান থাকে, তাহলে ২০৩৮ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ৪৫০ পিপিএম ছাড়াবে! এর মধ্যে ২০২০ সালে গ্রীনহাউজ গ্যাসের এই রেকর্ড বৃদ্ধি, দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সূত্র মতে, নোয়ার এই গবেষণার জন্য আধুনিক ইনস্ট্রুমেন্টাল পদ্ধতি অনুসরণ করে ডেটা সংগ্রহ করা হয়। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণে আনা হয় আট লাখ বছর আগের আইস কোর রেকর্ড।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৩৯ বছরের মধ্যে ২০২০ সালে মহাসাগরে জীবাশ্ম জ্বালানি নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ। এছাড়া, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড় কার্বন মাত্রার চেয়ে তা ৩০ শতাংশ বেশি।
পৃথিবীর মাত্র ২০টি দেশই মোট গ্রিনহাউজ গ্যাসের ৮০ শতাংশ নির্গত করে। বিশ্বব্যাপী শীর্ষ সাতটি নির্গমনকারী দেশ হলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিল।
জাতিসংঘের আবহাওয়া দফতর বলছে, পৃথিবী এখন ভীতিকর গতিতে এমন এক যুগে প্রবেশ করছে যখন চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া এবং সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধিসহ কী ঘটবে কিছুই বলা যায় না। গত আট লক্ষ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ এখন সবচাইতে বেশি।
গত বছর, জলবায়ু নির্দেশক বেশ কিছু সূচকে রেকর্ড মাত্রা দেখা যায়। টানা নয় বছর থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে নতুন রেকর্ডে গিয়ে পৌঁছায়। হিমবাহ ও বরফের স্তর গলে যাওয়ার প্রতি দশকে বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক ইঞ্চিরও কিছু বেশি বেড়ে চলেছে। একইসঙ্গে উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র।
এছাড়া, দু’শ বছরের মধ্যে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তিনটি তাপমাত্রার মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালে রেকর্ডকৃত ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা।
জলবায়ু এবং বায়ুমণ্ডলে পরিবর্তন আসায় তীব্র খরা, দাবানল, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়, বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত থেকে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়ছে।
প্রাথমিক ভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে মানব নিঃসৃত গ্রিন হাউজ গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা।
বিপজ্জনকভাবে বাড়তে থাকা উষ্ণায়ন ঠেকাতে চলতি দশকের মধ্যেই নাটকীয়ভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
তীব্র তাপে পুড়ছে পৃথিবী
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এখনো শেষ হয়নি। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এরকমই একটি আশঙ্কার কথা শোনালেন গবেষণা প্রতিবেদন সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশেষ প্যানেল আইপিসিসি।
সেখানে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে যেখানে এই শতকের শেষে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল সেটা বাড়বে মাত্র ১৫ বছরের মধ্যেই। এর ফলে কার্যত সমস্যার মধ্যে পড়তে চলেছে আমাদের গোটা পৃথিবী। মূলত এই গবেষণা বাস্তব রূপ নিচ্ছে এখনি। দাবানলে পুড়ছে গোটা পৃথিবী।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, “রিপোর্টের ফল দেখে এটা নিশ্চিত যে আমরা এরইমধ্যে জলবায়ু সংকট এর ভিতরে পড়ে গিয়েছি। প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অতিবৃষ্টির খরা আর বৃদ্ধি পায় ৭%। শক্তিশালী সাইক্লোন এর হার বৃদ্ধি পায়।”
“যদি এরকম ভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে আগামী দশকে দুই থেকে তিনবার ভয়ানক বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রচুর বনাঞ্চল শুকিয়ে যাবে, বেশ কিছু জায়গায় খরা পরিস্থিতি দেখা যাবে। গরমকালে তীব্র তাপমাত্রা আবার বর্ষাকালে প্রচন্ড বৃষ্টি এই বিষয়টি প্রচন্ডভাবে লক্ষ্য করা যাবে।”
আইপিসিসি ওয়ার্কিং গ্রুপের ভ্যালেরি ম্যাসন ডেলমেট বলছেন, “এই প্রতিবেদনটি আসলে একটি বাস্তবতা। প্রতিবেদন এই বিষয়টির দিকে নির্দেশ করছে, জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে এবং গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন করে মানুষ পৃথিবীর তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই প্রাক-শিল্প যুগের থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়ে ফেলেছে।
এর ফলে, মানব দ্বারা তৈরি কারণে প্রায় প্রত্যেক দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে তাপমাত্রা এই শতকের শেষের দিকে মনে করা হয়েছিল, তা এর অনেক আগেই হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রীতিমতো সমস্যার মধ্যে পড়তে চলেছে আমরা।”
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪০৭
আপনার মতামত জানানঃ