চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় অপরাধী না হয়েও হাজতবাস করেন নিরপরাধ মো. রুবেল নামে এক কৃষক। তার বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় কোনো মামলা নেই। শুধু নামের মিল থাকায় পারিবারিক আদালতে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এক দিন কারাভোগের পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুক্তি পান রুবেল নামের ওই কৃষক।
নামের মিল থাকায় চট্টগ্রামের হাটহাজারীর রুবেলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছিল। একদিন কারাভোগের পর মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) আবেদন করলে চট্টগ্রাম পারিবারিক আদালতের বিচারক নিশাত সুলতানা রুবেলের জামিনের মঞ্জুর করেন। পরে সন্ধ্যায় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন নিরপরাধ রুবেল।
আদালত সূত্র জানায়, জেলার হাটহাজারীর দেওয়ান নগর এলাকার আছমিদা আক্তার তার স্বামী মুহাম্মদ রুবেলের বিরুদ্ধে দেনমোহরের টাকার জন্য চট্টগ্রামের পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। রুবেলের বাবার নাম নুরুল আলম আর মায়ের নাম লায়লা বেগম। রুবেল পেশায় জিপগাড়ির চালক। আদালত পরে রুবেলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
এই পরোয়ানায় হাটহাজারী থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন পশ্চিম দেওয়ান নগরের সন্দীপপাড়ার নুরুল আলমের ছেলে মো. রুবেলকে গত রোববার রাত ১২টার দিকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। পরদিন সোমবার তাকে আদালতে হাজির করে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এই রুবেলের মায়ের নাম ছদুরা খাতুন। পরে রুবেলের স্বজনেরা তার মুক্তির জন্য আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করেন।
কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, পুলিশকে বারবার বলা হলেও শোনেনি। তারা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। অপরাধী না হয়েও আমাকে এক দিন কারাবাস করতে হয়েছে। আমি দোষী পুলিশের শাস্তি চাই।
মামলার বাদী আছমিদা আক্তারের আইনজীবী সাহেদা বেগম বলেন, তারা যে রুবেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, পুলিশ সেই রুবেলকে গ্রেপ্তার করেনি। নিরীহ আরেকজনকে ধরে নিয়ে এসেছে। আমরা প্রকৃত আসামির শাস্তি চাই। নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন।
রুবেলের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আছমিদা আক্তার নামে একজন তার স্বামী মোহাম্মদ রুবেলের বিরুদ্ধে আদালতে দেনমোহরের জন্য মামলা দায়ের করেন। ওই ঘটনায় রুবেলের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু মামলার বাদী যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন তাকে গ্রেপ্তার না করে নামের মিল থাকায় রুবেল নামের আরেকজনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু দুজনের নামের মিল থাকলেও ঠিকানা ভিন্ন। এছাড়া দুইজনের পিতার নামের মিল থাকলেও মায়ের নামের ভিন্নতা রয়েছে। দুজনের পরিচয়পত্রও আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া মামলার বাদীও গ্রেপ্তারকৃত রুবেল প্রকৃত আসামি নয় বলে জানিয়েছেন। মঙ্গলবার জামিনের আবেদন করলে চট্টগ্রাম পারিবারিক আদালতের বিচারক নিশাত সুলতানা জামিন মঞ্জুর করেন। পরে আদেশনামাটি কারাগারে পাঠানোর পর সন্ধ্যায় মুক্তি পান রুবেল।
নিরপরাধ রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হাটহাজারী থানার এএসআই আমির হোসেন বলেন, ইচ্ছা করে গ্রেপ্তার করা হয়নি। নামের মিল থাকায় ধরা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর নাম-ঠিকানা যাচাই–বাছাই করা হয়নি কেন, প্রশ্নের জবাবে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি। গ্রেপ্তার ব্যক্তি বলার পরও কেন যাচাই করা হয়নি, প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি এএসআই আমির হোসেন।
রুবেলের বড় ভাই মো. খোকন বলেন, ‘আমার ভাইয়ের তিনটি সন্তান। কখনো কৃষিকাজ আবার কখনো নির্মাণশ্রমিকের সহকারী হিসেবে কাজ করে সংসার চালান। মামলা না থাকলেও রাতে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ায় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। তবে ভবিষ্যতে নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য দায়ী পুলিশের ব্যবস্থা হওয়া উচিত।’
প্রকৃত আসামিকে বাদ দিয়ে নিরীহ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করায় হাটহাজারী থানার এএসআই আমির হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিতে কাল বুধবার আদালতে আবেদন করবেন বলে জানান রুবেলের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন।
আইনের ভাষায় একটা কথা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত আছে, প্রয়োজনে দশজন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক তবুও যেন একজন নিরপরাধীর সাজা না হয়। বিশ্বের সমস্ত বিচার ব্যবস্থায় এই কথাটি মোটা অক্ষরে স্মরণে রাখা হয়। নিরপরাধীর সাজা যেন না হয় সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। তারিখের পর তারিখ, বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই শেষে আদালত এইজন্যই বিচারের রায় প্রদান করে থাকেন যাতে ফাঁক-ফোঁকরে কোনো নিরপরাধীর সাজা না হয়ে যায়। বাংলাদেশেও এই রীতি রয়েছে। তবুও কোথায় কার যেন ভুলে কীভাবে যেন নিরপরাধীর সাজা হয়ে যায়। এদেশে এই সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে নিরপরাধীর সাজাভোগের উদাহরণ খুঁজে দেখলে দেখা যাবে প্রকৃত আসামির সংখ্যার চেয়ে অতো একটা কম নয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, একটা মানুষের খুন হওয়ার ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দ্রুততম সময়ে আসামির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। কারাভোগের পর কেউ খালাস পেলেও তাকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পুলিশের গাফিলতিতে একজন নিরপরাধের কারাভোগ দেশের প্রশাসনের আসল চিত্রটা ফুটে ওঠে। দায়িত্বে কতটা অসচেতন হলে একজন পুলিশ কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই অপরাধী বানিয়ে ফেলে! এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৯
আপনার মতামত জানানঃ