আরবের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। এর ওপর মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট গত ছয় বছর ধরে দেশটির ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে ইয়েমেনের কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৩৬ লাখ মানুষ। দেশটির অবকাঠামো খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে।
ইয়েমেনে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত মার্টিন গ্রিফিথস সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘প্রায় ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবল এবং এর সঙ্গে থাকা রোগ থেকে এক কদম দূরে রয়েছে।’ এছাড়া আরও দশ লাখ মানুষ তাদের ঠিক পেছনে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, ‘দুর্ভিক্ষ কেবল খাদ্যের সমস্যা নয়। এটা আরও গভীর বিপর্যয়ের লক্ষণ। বহু ভাবেই ইয়েমেনের সব সমস্যা এক বিন্দুতে এসে মিলছে আর এটি মোকাবিলায় আরও সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।’
ইয়েমেনে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিদায়ী বিশেষ দূত বলেছেন, দেশটিতে চলমান দুর্ভিক্ষকে সবচেয়ে বেশি মানবিক অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্টিন গ্রিফিথস জানিয়েছেন, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ বা ২ কোটি মানুষ নিত্য প্রয়োজন মেটাতে মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল।
ইয়েমেনের নাগরিকদের এই অনাহারের সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্ক রয়েছে দেশটির মারাত্মক মুদ্রা স্ফিতি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের। ২০১৫ সালে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে ইয়েমেনের জিডিপি পড়ে গেছে ৪০ শতাংশ। আর ইয়েমেনি রিয়ালের দর মার্কিন ডলারের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ নেমে গেছে।
জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সহকারী মহাসচিব খালেদ মোহাম্মদ খিয়ারি আরও সতর্ক করে জানিয়েছেন, ইয়েমেনে হুথি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তেল সংকট আরও মারাত্মক হয়ে উঠছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুদ্ধের ফলে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার ইয়েমেনের নারী ও শিশুরা। তীব্র অপুষ্টির শিকার ১২ লাখ নারী ও ২৩ লাখ শিশুর জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন। এর মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে চার লাখ শিশু।
সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসেবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তীব্র অপুষ্টিতে মারা গেছে ৮৫ হাজার শিশু। জাতিসংঘের হিসেবে দেশটির এক কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক কদম দূরে রয়েছে।
প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সুবিধা না পাওয়ায় ২০১৭ সালে ইয়েমেনে ভয়ংকর রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা রোগ। ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে কলেরায় সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ সৌদি আরব যুদ্ধ বন্ধ তো দূরের কথা এক প্যাকেট স্যালাইনও ইয়েমেনে পাঠায়নি। মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো দেশটিতে এখন বাড়তে শুরু করেছে করোনার সংক্রমণ। এ পর্যন্ত এক হাজার ২০০ এর বেশি ইয়েমেনি করোনায় মারা গেছেন।
ইয়েমেনের মানবিক পরিস্থিতির বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। যদি চলতি বছরে জরুরিভিত্তিতে যথাযথ সহায়তা করা না যায় তাহলে ইয়েমেন মৃত্যুকূপে পরিণত হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস। ইয়েমেনে সহায়তার জন্য যে পরিমাণ অর্থ জাতিসংঘ চেয়েছে তার অর্ধেক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দাতারা। তারপরই এমন সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
গুতেরেস বলেন, লাখ লাখ ইয়েমেনি শিশু, নারী এবং পুরুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরিভিত্তিতে সহায়তা প্রয়োজন। এই সহায়তা যদি কমানো হয় তাহলে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে দাতারা যে সাড়া দিয়েছেন তাকে ‘হতাশাজনক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘ প্রধান।
গুতেরেস জানিয়েছেন, সাহায্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া মানে, ইয়েমেনের মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া। লক্ষ্য ছিল ৩৮৫ কোটি ডলার তোলার। মোট একশটি দেশের কাছ থেকে এই অর্থ জোগাড় করা হচ্ছিল। জাতিসংঘের মতে, মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে মাত্র ১৭০ কোটি ডলার উঠেছে।
তাই গুতেরেস জানিয়েছেন, পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। ২০১৯ সালে দেশগুলি ইয়েমেনকে সাহায্য করার জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা রাখেনি। ফলে ইয়েমেনে মানুষের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে শৈশব নারকীয়। তাদের না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই গুতেরেসের আবেদন, সব দেশই আবার বিষয়টি ভেবে দেখুক এবং প্রতিশ্রুত অর্থ দিক। না হলে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ থেকে ইয়েমেনকে বাঁচানো যাবে না।
জাতিসংঘের হিসাব, এই বছর দেশের এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ না খেয়ে থাকবেন। পাঁচ বছরের কম বয়সী চার লাখ শিশু না খেতে পেয়ে মারা যেতে পারে।
২০১৪ সালে হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। পরে সরকারি বাহিনীর পক্ষে সৌদির নেতৃত্বে হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে কয়েকটি দেশ। কয়েক বছর ধরে চলা যুদ্ধে মহাবিপর্যয়ে পড়েছে সবচেয়ে দরিদ্র আরব দেশটির সাধারণ মানুষ। খাবার ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৭
আপনার মতামত জানানঃ