যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনীর প্রায় দুই দশকের উপস্থিতির অবসান ঘটিয়ে সম্প্রতি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পর তালিবান শরিয়াহ বা ইসলামী আইনের ভিত্তিতে দেশটি শাসন করবে বলে জানিয়েছে। পাশাপাশি আফগান নারীদের সে আইন অনুযায়ী জীবনচর্চা করতে হবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছে এই সংগঠিনটি।
পূর্ববর্তী তালিবান শাসনে আফগানিস্তানে নারীর অধিকার সুরক্ষিত ছিল না একেবারেই। এমনই মনে করেন বিশ্বের অধিকাংশ মানবাধিকার কর্মী। নব্বই দশকে তালিবানের শাসনামলে শরিয়াহ আইনের নামে নারীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল। তাই এবার তালিবানের আফগান দখলের পর নারীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, অত্যাচার এবং নিপীড়ন শরিয়াহসম্মত কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ মুসলিম সমাজে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যে তালিবান সরকার ছিল, তারাও শরিয়াহ আইনের কথা বলতো। সেখানে দশ বছরের বেশি বয়সের মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হতো না। কোনোরকম বাইরের কাজে তাদের অংশ নিতে দেওয়া হতো না। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া রাস্তায় বের হতে দেওয়া হতো না। বোরকা পরা ছিল বাধ্যতামূলক। সমস্ত মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল নারীরা। তাদের বেঁচে থাকতে হতো আতঙ্কের মধ্যে।
তালিবান এবারেও জানিয়েছে, শরিয়াহ আইন মেনেই নারী অধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। ফলে আগের চেয়ে বিশেষ কোনো পরিবর্তন হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। যে জন্য দেশটি থেকে পালাচ্ছেন অভিনেত্রী, গায়িকা, খেলোয়ার, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নারী কর্মীরা, এমনকি গৃহিনীরাও। যারা পালাতে পারছেন না, তারা দিন গুনছেন শঙ্কায়, মৃত্যুভয়ে।
অথচ নারী-পুরুষের সমতা বিধানের ক্ষেত্রে ইসলামে বলা হয়েছে, “ঈমানদার অবস্থায় যে কেউ নেক আমল ও সৎকর্ম সম্পাদন করবে, সে পুরুষ হোক অথবা নারী, তাকে আমি অবশ্যই (দুনিয়ার বুকে) পবিত্র জীবন দান করব এবং পরকালের জীবনেও উক্ত নেক আমলের জন্য উত্তম বিনিময় দান করব” (সূরা আন-নাহল : ৯৭)। এ আয়াতে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এখানে মানবিক অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে সমস্ত মানুষই সমান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের গবেষণা পরিচালক ডালিয়া মোজাহেদ গণমাধ্যম আল জাজিরাকে জানান, সপ্তম শতাব্দীতে নারীদের সম্পদ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি নাকচ করে দেয় ইসলাম। এর পরিবর্তে আর্থিক সিদ্ধান্ত ও সম্পদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের আসনে বসানো হয় নারীকে।
শুধু তা-ই নয়, বিয়ের সঙ্গী পছন্দের পাশাপাশি তার সঙ্গে বিচ্ছেদের অধিকারও নারীকে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘প্রাপ্তবয়স্কা নারীকে তার সম্মতি ব্যতীত বিবাহ দেওয়া যাবে না।’ ইসলামি বিধান অনুযায়ী তালাকপ্রাপ্তা অথবা বিধবা নারীদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ারও স্বাধীনতা রয়েছে। এছাড়া পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সম্মানকে অর্থবহ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।’
ডালিয়া জানান, ইসলামে বিশ্বাসীদের প্রথম প্রজন্ম থেকেই চিকিৎসাকর্মী থেকে শুরু করে যোদ্ধা-জীবনের সব ক্ষেত্রেই নারীদের বিচরণ দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে রুফাইদা আল-আসলামিয়ার কথা বলা যায়। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা, অন্য নারীদের নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখায় মহানবী (সা.) নিজে রুফাইদাকে সার্জনের স্বীকৃতি দেন।
এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক পুরুষ যেখানে পালিয়ে যায়, সেখানে মহানবীকে বাঁচান নুসাইবাহ বিনতে কাব। এ জন্য ‘নবীর ঢাল’ নামে পরিচিতি পান তিনি।
পাশাপাশি নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তায় জোর দেয় ইসলাম। এক হাজার বছরের বেশি সময় আগে বিশ্বের প্রথম জ্ঞাত বিশ্ববিদ্যালয় মরক্কোর ফেজ শহরের ইউনিভার্সিটি অফ আল-কারাউয়িইন প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা আল-ফিহরি নামের এক মুসলমান নারী।
ফাতিমা ও তার বোন মরিয়ম উচ্চশিক্ষিত ও ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ দুই বোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ইউরোপীয় দেশগুলোর কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই মুসলমান নারীরা সম্পদের ভাগ পেতেন।
জ্ঞানের প্রতি ফাতিমা ও মরিয়মের অগাধ আগ্রহ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। চার বছর আগে যুক্তরাজ্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ আকরাম নাদউয়ির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ডালিয়ার। হাদিসের নারী পণ্ডিতদের নিয়ে জ্ঞানকোষ রচনা করেন নাদউয়ি।
তিনি জানান, শুরুতে নারী হাদিস পণ্ডিতদের নিয়ে ছোট বই লেখার কথা ভেবেছিলেন তিনি। গবেষণার একপর্যায়ে দেখেন, নারী পণ্ডিত কয়েকজন নয়, হাজার হাজার রয়েছে। প্রায় ৯ হাজার নারী পণ্ডিত নিয়ে অবশেষে ৫৭টি খণ্ডে বইটি লিখতে সক্ষম হন তিনি।
নাদউয়ি তার গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, আরও হাজার হাজার নারীকে নিয়ে লিখতে পারবেন। তিনি জানান, নারীরা কেবল শিক্ষার্থীই ছিলেন না। মুসলমানদের ঐতিহ্যের স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত অনেক পণ্ডিতেরই নারী শিক্ষক ছিল।
নারীর অধিকার প্রসঙ্গে ইসলামে বলা হয়েছে, ‘নারীদের (পুরুষদের উপর) তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমনি রয়েছে নারীদের উপর পুরুষদের’ (সূরা আল বাকারা :২২৮)। এসব সত্ত্বেও নারীর প্রতি তালিবানের আচরণকে ইসলামের বিচ্যুতি নয়, ধর্মসম্মত হিসেবে দেখা হচ্ছে। কাবুল পতনের পর এরই মধ্যে আফগানিস্তানে শরিয়াহ আইনের নামে নারীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা শুরু করেছে তালিবান।
জোর করে নারীদের তালিবান যোদ্ধাদের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি জনসমক্ষে তাদের বেত্রাঘাত করা হচ্ছে। ইসলামে নারীর অবস্থানের বিপরীতে তালিবানের এই নারী নির্যাতন ও নিপীড়ন, মূলত ধর্মের অবমাননা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭২২
আপনার মতামত জানানঃ