সদ্য কাবুলের মসনদ দখল করা আফগানিস্তানের তালিবান শাসকরা দ্রুতই ক্রমবর্ধমান এক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে চলেছে। কারণ বর্তমানে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের অধিকাংশই তালিবানের হাতের নাগালে নেই এবং পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীরা— যারা কিনা দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তহবিলের ৭৫ শতাংশের যোগান দিতেন, তারা হয় ইতিমধ্যে অর্থ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, না হয় বন্ধের হুমকি দিচ্ছে।
পাশাপাশি নিজের গর্ত নিজেই খুঁড়ে রেখেছে তালিবান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য ইরান, পাকিস্তান এবং উপসাগরীয় ধনী দাতাদের থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধা বেশ কিছুটা কমিয়ে এনেছে। যার ফলে গত বছর তাদের তহবিলে ছিল মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলার। যা একটি দেশ চালাতে প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় একেবারেই নগন্য।
গত বুধবার, আফগানিস্তানের কেন্দ্রিয় ব্যাংকের গভর্নর জানান, বিদেশে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ ৯ বিলিয়ন ডলার; তবে গত রোববার বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে থাকা আফগান সরকারের একাউন্ট জব্দ করার পর দেশটিতে এখন কোনও প্রকার নগদ অর্থ নেই।
গত বুধবার, আজমাল আহমাদি টুইটারে লেখেন, এই অর্থের অধিকাংশটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারাল রিজার্ভ বন্ড, স্থায়ী সম্পদ এবং সোনা; যার পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি এটাও জানান যে, দেশটির হাতে এখন মার্কিন ডলারের পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি। গত সপ্তাহে তালিবানের আক্রমণের মুখে দেশটির পরিকল্পিত অর্থ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যআয়।
‘পরবর্তী সরবরাহ আর কখনওই পৌঁছাবে না’- তিনি লেখেন। ‘মনে হচ্ছে আমাদের অংশীদারদের বেশ ভালোই বোঝাপড়া ছিল যে আফগানিস্তানে কী ঘটতে যাচ্ছে।’
আহমাদি উল্লেখ করেন, মার্কিন ডলারের এই অভাবে দেশটিতে মুদ্রাহ্রাস ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে, বিপদে পড়বে দেশের গরীব মানুষেরা। এখন রিজার্ভ ফিরে পাওয়া বেশ জটিল হয়ে উঠেছে, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন সরকার তালিবানকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
‘তালিবান যুদ্ধ জিতেছে’ এখন দেশ চালাতে হবে’- তিনি লেখেন। ‘তবে যুদ্ধে জেতার মতো এটা সহজ কাজ নয়।’
দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞায় তালিবান গত পাঁচ বছরের বহুলভাবে আফিম ব্যবসায়ের উপর নির্ভর করে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে নতুন এক ধরনের আফিম গাছ ছিল, যা বছরে দুই বারের পরিবর্তে তিনবার চাষ করা যায়।
দুই বছর আগে ন্যাটোর একটি গোপণ প্রতিবেদনে এক আন্দোলন সম্পর্কে জানা যায়। যেটা মূলত তালিবানের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বাধীনতা অর্জন বা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছানো প্রসঙ্গে। এই আন্দোলনে কোনও সরকার বা কোনও দেশের নাগরিকদের সহায়তা ছাড়াই, তালিবান নিজেদের অভ্যুত্থানের আর্থিক দিকটা নিজেরাই সামলে নিতে সক্ষম হওয়ার চেষ্টা করছিল বলে জানা যায়।
কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য আর্থিক তহবিলের যোগান দেওয়া আর দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যই বহির্বিশ্ব থেকে তালিবানকে আর্থিক সুবিধা পেতে, তাদের আদর্শগত জায়গা থেকে সরে অধিকতর নমনীয় হবার পূর্বাভাস দিচ্ছে।
চলতি বছরে জন সপকো, আফগানিস্তানের পুনর্গঠন বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ মহাপরিদর্শক বলেন, তালিবানরা বুঝতে পেরেছে আফগানিস্তানের বৈদেশিক সহায়তা কতটা ভয়াবহভাবে প্রয়োজন। তবে এ সত্ত্বেও বুধবারে তালিবানের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দেশটি থেকে আফিমের রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের মতে ২০২০ সালের শেষের দিকে সারা বিশ্বের ৮৪ শতাংশ আফিম উৎপন্ন হয়েছিল আফগানিস্তানে। যার অধিকাংশটাই উৎপন্ন হয়েছিল তালিবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে; যার ফলে তারা ১০ শতাংশ উৎপাদন কর পেয়েছিল।
জাতিসংঘের মতে, গত চার বছরের মধ্যে তিন বছরেই দেশটিতে আফিমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। পপি ফুলের চাষাবাদের মাধ্যমে শুধু গত বছরেই আফিম উৎপাদন বেড়েছে ৩৭ শতাংশ।
এছাড়া জাতিসংঘ, ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার মতে, তালিবানের অর্থ সংস্থানের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক খনিজ রপ্তানি; যা থেকে তাদের আয়ের এক তৃতীয়াংশ আসে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তালিবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বসবাসরত আফগানদের উপর আরোপ করা কর।
তবে সবথেকে বড় অর্থের যোগান এসেছে উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে। সেখানকার দাতাদের থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পেয়েছে তালিবান। তালিবান ইরান থেকেও সাহায্য পেয়েছে।
তবে দেশটির বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আফগান সরকারের দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সাহায্যের ক্ষেত্রগুলো হুমকির মুখে পড়েছে; যা কিনা দেশটির জিডিপির ৪২.৯ শতাংশ। তালিবানের জন্য এটাই পরিস্থিতি অধিক জটিল করে তুলেছে।
দেশটির অন্যতম প্রধান দাতা ছিল জার্মানি। জার্মানিও দেশটিতে তাদের উন্নয়নমূলক সাহায্য বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। আফগানিস্তানে এ বছরে ৩৬৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য দেওয়ার কথা ছিল বার্লিনের।
এদিকে, ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশন (এফআইইও)-র সূত্র মতে, ভারত-আফগান বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তালিবান। ভারতের সঙ্গে সকল আমদানি-রফতানি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে তারা।
ভারত আফগানিস্তানের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার। চলতি বছর এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে ভারতের রফতানির পরিমাণ প্রায় ৮৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে দেশটি থেকে ভারতের আমদানির পরিমাণ প্রায় ৫১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এছাড়া বাণিজ্যিক সম্পর্কের বাইরেও আফগানিস্তানে ভারতের বিপুল অংকের বিনিয়োগ রয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আফগানিস্তানে বর্তমানে ভারতের প্রায় ৪০০টি প্রকল্প চলছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩২৯
আপনার মতামত জানানঃ