যখন গোটা আফগানিস্তান জুড়ে তালিবানের আতঙ্কে পিছু হটেছিল আফগান বাহিনী, আত্মসমর্পণ করেছিল একের পর এক সম্মুখ যোদ্ধারা, পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল একের পর এক রাজনৈতিক নেতা, তখন চোয়াল শক্ত করে তালিবানের রক্ষচক্ষুকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন সালিমা মাজারি।
দুই দশক ধরে তিল তিল করে একটা নতুন স্বপ্ন বুনেছিলেন আফগানরা। সেই স্বপ্ন ভাঙতে সময় নিল মাত্র তিন মাস। গোটা আফগানিস্তান এখন তালিবানের দখলে। তাদের সন্ত্রাসের ভয় প্রাণপণে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন আফগান জনতার একাংশ।
বিভিন্ন সূত্র মতে, আফগানিস্তানের এই মহিলা গভর্নর সালিমা মাজারিকে আটক করেছে তালিবান। আশরাফ গনি সরকারের শাসনকালে আফগানিস্তানের যে তিন জন মহিলা গর্ভনর ছিলেন তাদের মধ্যে এক জন সালিমা।
একের পর এক প্রদেশ যখন বিনা বাধায় তালিবানের দখলে চলে যাচ্ছিল, বলখ প্রদেশের রক্ষায় সালিমা হাতে তুলে নিয়েছিলেন বন্দুক। দেশের অন্যান্য প্রদেশ বিনা যুদ্ধে দখল করলেও বলখ প্রদেশে সালিমা বাহিনীর কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় তালিবানকে।
মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করাতেই বাড়বাড়ন্ত শুরু হয় তালিবানদের। একের পর এক প্রদেশ দখল নিতে শুরু করে তারা। কিন্তু নিজের প্রদেশে তালিবানদের পা-ও রাখতে দেননি সালিমা। সেখানকরা বাসিন্দাদের নিয়েই তৈরি করে ফেলেন কার্যত দুর্গ। পাশাপাশি অস্ত্র নিয়ে এসে বানিয়ে ফেলেন নিজের সেনাও। এই বাহিনীকে কেউ পেশাদার সেনা নয়। সবাই সাধারণ মানুষ।
তবে দু’পক্ষের তুমুল সংঘর্ষ হয় ঠিকই, কিন্তু তালিবানের বিপুল লোকবলের কাছে এঁটে উঠতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। বলখ প্রদেশের পতন হয়। একই সঙ্গে সালিমার চাহার কিন্ট জেলাও দখল করে নেয় তালিবান।
গোটা দেশের মধ্যে চাহার কিন্টই ছিল একমাত্র মহিলা পরিচালিত অঞ্চল যা কোনও দিন কোনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেনি। নিজের শেষ শক্তি দিয়ে বলখ প্রদেশ এবং চাহার কিন্টকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন সালিমা।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিলেন সালিমা। মহিলাদের মধ্যে তার প্রভাব ছিল অনেকটাই। দেশে যখন তালিবানি তাণ্ডব শুরু হয়, দেশের মানুষ এবং মহিলাদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
তালিবানের খাঁড়া যে তার উপরও নেমে আসতে পারে যেকোনও মুহূর্তে, সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন সালিমা। শেষমেশ সেই আশঙ্কাই সত্যি হল! এই মহিলা গভর্নরকে বন্দি বানানো হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র মারফৎ দাবি করা হচ্ছে।
তিন বছর আগে গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে ৩০ হাজার মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব একাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সালিমা। তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো তার কাছে নতুন কিছু নয়। এক জন আমলা হিসেবে শুধু প্রশাসনিক কাজ সামলানো নয়, পাশাপাশি সেনা অভিযানের বিষয়ও তাকে দেখাশোনা করতে হত।
সালিমা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “নিজের দফতরের কাজও যেমন সামলেছি, পাশাপাশি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হাতে বন্দুকও তুলে নিয়েছি।”
সালিমা বলেছিলেন, “আমরা যদি সন্ত্রাসবাদী ভাবনাচিন্তা, সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তা হলে তাদের হারানোর সুযোগ পাব না। আর সন্ত্রাসবাদীরা জিতলে গোটা দেশে তাদের ভাবনাচিন্তাকে ছড়িয়ে দেবে। দেশে একটা অস্থিরতা তৈরি হবে।”
আফগানিস্তানে মোট ৩ জন মহিলা গভর্নর ছিলেন। তার মধ্যে রয়েছেন সালিমাও। আফগানিস্তানের চাহার কিন্টের গভর্নর তিনি। সেখানে প্রায় ৩২ হাজার মানুষের বাস রয়েছে। কাবুলের দখলের পরেই এই এলাকাটি তালিবানের টার্গেটে ছিল। মাঝে একাধিকবার হামলাও হয়। কিন্তু বারবার হামলাতে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় সালিমার বাহিনীর।
সালিমার জন্ম ইরানে হলেও, পরবর্তীকালে তিনি আফগানিস্তানে চলে আসেন। এখান তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেন। পরবর্তীকালে আফগানিস্তানের সক্রিয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৪২
আপনার মতামত জানানঃ