প্রচলিত আছে যুক্তরাষ্ট্রকে বোকা বানিয়েছেন মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার। তবে তালিবানের কাছে তিনি জনপ্রিয় ‘মোল্লা বারাদার আখুন্দ’ নামে। আখুন্দ পার্সি ভাষায় সাধারণত পণ্ডিতদের কথাই বোঝানো হয়। মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদারের পাণ্ডিত্যের কোনও সরকারি প্রশংসাপত্র পাওয়া না গেলেও তার কৌশলের দক্ষতা ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় স্বীকৃত।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর কাছে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ২০ বছর পর ফের আফগানিস্তানের ক্ষমতা নিচ্ছে তালিবান। তালেবানের সিনিয়র নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার আফগানিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো এই তালিবান কমান্ডার কোনো শীর্ষ পদে বসতে চলেছেন। মূলত মোল্লাহ বারাদারের পরিচয় তিনি তালিবান মস্তিষ্ক এবং রাজনৈতিক প্রধান।
বারাদার কখনও প্রধান ছিলেন না তালিবানের। বরাবর দ্বিতীয় স্থানে কাজ করা বারাদারের ভূমিকা ছিল তালিবান কৌশলীর। আড়ালে থেকে প্রধানের মস্তিষ্ক হয়ে কাজ করেছেন। বহু বছর সামনে আসেননি।
তবে প্রধান না হয়েও দেশে তো বটেই এমনকি আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তার অবস্থানই ছিল তালিবানের শেষ কথা। তালিবানের রাজনৈতিক অবস্থানগত কৌশল কিংবা অভিমুখ তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন। আর তাই প্রধান না হয়েও তিনিই তালিবানের প্রধান মুখ।
মোল্লাহ আব্দল গনি বারাদারের জন্ম ১৯৬৮ সালে কান্দাহার প্রদেশে। জন্মসূত্রে এই তালিবান নেতা একজন দুররানি পশতুন। দুররানিরা আফগানিস্তানের আদি গোষ্ঠী। তাদেরই পূর্বপুরুষ আহমেদ শাহ দুররানি আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
দেশের হয়ে বারাদার যুদ্ধ করছেন কিশোর বয়স থেকে। আশির দশকে সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণে চলা আফগান শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তখন আফগান মুজাহিদিনের সদস্য হয়েছিলেন। বারাদারের সহযোদ্ধা ছিলেন তালিবানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ওমর।
বারাদার সেই ১৯৯২ সাল থেকে ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তানের স্বপ্ন দেখছেন। আফগানিস্তানকে আমিরাত বানানোর লক্ষ্যে সেই সময়েই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি মাদ্রাসা। যার উদ্দেশ্য ছিল, আফগানিস্তানের ধর্মীয় শুদ্ধিকরণ করে তাকে প্রকৃত ইসলামি আমিরাত হিসেবে গড়ে তোলা।
মোহাম্মদ ওমর তখন ধর্মীয় নেতা। শোনা যায়, বারাদারের ভায়রা ভাই তিনি। ওমর এবং বারাদারের উদ্যোগেই তৈরি হয় মাদ্রাসাটি। নাম দেওয়া হয় ‘তালিবান’। তালিবানের যাত্রা তখন থেকেই শুরু। আর এর ঠিক পাঁচ বছরের মাথাতেই সাফল্য আসে তালিবানদের।
১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের দখল নেয় তালিবান। রোববার রাতে তালিবান যেভাবে কাবুল দখল করেছে ঠিক সেভাবে আফগানিস্তানে শুরু হয় তালিবানি শাসন। সেই রাষ্ট্রে প্রধান ছিলেন ওমর। বারাদার দায়িত্ব নেন আফগান সেনাদের।
২০০১ সালে মার্কিন সেনারা যখন আফগানিস্তান থেকে তালিবানকে উৎখাত করে, তখন বারাদার ছিলেন আফগানিস্তানের উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই তালিবানের প্রশাসনিক সংগঠন ‘কোয়েত্তা সুরা’ গঠন করেন।
তারপর বহুবার তালিবানের হয়ে বার্তা নিয়ে আফগান প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে আলোচনা অনেকটা এগিয়েছিল। এক সময়ে তাকে তালিবানের ‘শান্তির মুখ’ হিবেবে দেখতে শুরু করেছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
কিন্তু ২০১০ সালে আচমকাই বারাদারকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ তখন বলেছিল এই গ্রেফতারির নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশ রয়েছে। তবে পরে যুক্তরাষ্ট্রই ইসলামাবাদকে বারাদারকে মুক্তি দিতে বলে।
২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন তার সঙ্গে কথা বলে তালিবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছিল। তার আশ্বাসে আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি পাকিস্তানের জেলে বন্দি বারাদারকে মুক্ত করার নির্দেশও দিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মুক্তি পেয়ে তখন কাতারের রাজধানী দোহায় রয়েছেন বারাদার। সেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালিবানের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তিতে তালিবানদের ক্ষমতা সংক্রান্ত সমঝোতায় আসার সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের তরফে। সেনা প্রত্যাহারের এই সময়সীমা ছিল আগামী ৩১ আগস্ট।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র যতদিনে আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা সরিয়েছে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়েছে তালিবান। কারণ সেনা সরলেই আক্রমণ করবে বলে। আসলে কৌশলী মোল্লাহ বারাদার বরাবরই ধৈর্যশীল। কারণ, তিনি এটা জানেন সবুরেই মেওয়া ফলে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ