অভিযোগ আছে কখনো সাদাপোশাকে, আবার কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে যায়। পরে কারও কারও লাশ পাওয়া যায়, একেবারেই নিখোঁজ রয়েই যায় অনেকে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে যে, বাংলাদেশে গুমের শিকার ৮৬ জন ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। খবর বিবিসি
২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ১১৫ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে গুমের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী, তাদের পরিবারের সদস্য এবং গুমের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা ছিলেন।
এসব গুমের ঘটনার উল্লেখ করে প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, এগুলোর নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু করা উচিৎ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাবি করেছে যে প্রতিবেদনটি তৈরি করার সময় তারা দেখেছে যে, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে এবং তাদের মত দাবিয়ে রাখতে গুম এবং গুমের হুমকিকে ব্যবহার করেছে।
বাংলাদেশের সরকার অবশ্য গুমের ঘটনায় কোন কতৃপক্ষ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে।
প্রতিবেদনে সাত জন ভুক্তভোগীর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে যারা গুম হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথেও কথা বলেছে মানবাধিকার সংস্থাটি।
যাদের সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তারা হলেন,
- বিএনপি নেতা আব্দুল কাদের ভূঁইয়া বা মাসুম যাকে ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তার মা আয়েশা আলীর দাবী তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
- বিএনপির একজন নেতা নূর হাসান হিরু যাকে ২০১১ সালের ২০শে জুন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ৫-৬ জন তুলে নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করে। এর পর থেকে আর তার খোঁজ নেই বলে জানায় তার ভাই।
- ছাত্র শিবির কর্মী মোহাম্মদ রেজাউন হুসাইন যাকে ২০১৬ সালের অগাস্টে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করে। তার মা সেলিনা বেগমের দাবি, এরপর থেকে আর তার খোঁজ মেলেনি।
- মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম রাজাকে তার আরো কয়েক জন বন্ধুর সাথে ২০১৩ সালের ২৬শে এপ্রিল থেকে নিখোঁজ। তার মায়ের দাবি, পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, পরে তার বন্ধুদের ছেড়ে দেয়া হলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছেন রাজা।
- তপন চন্দ্র দাশ নামে এক ব্যবসায়ীকে ২০১১ সালের ৩রা অগাস্ট পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা পরিচয়ে কয়েকজন আটক করে নিয়ে যায়।
- মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, যিনি সুইফট কেবল নেটওয়ার্ক নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি ২০১৩ সালের ১১ই মে থেকে নিখোঁজ।
- মীর আহমেদ বিন কাশেম যিনি আরমান নামেও পরিচিত তাকে ২০১৬ সালের ৯ই অগাস্ট তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় এ দাবি করা হয় যে, দেশে কোনো ধরনের গুমের ঘটনাই ঘটে না। কিন্তু দেশের এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো জোর দিয়ে বলে আসছে, বাংলাদেশে গুমের ঘটনা অব্যাহত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাবি করেছে যে প্রতিবেদনটি তৈরি করার সময় তারা দেখেছে যে, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে এবং তাদের মত দাবিয়ে রাখতে গুম এবং গুমের হুমকিকে ব্যবহার করেছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুয়ায়ী গত ১৩ বছরে (২০২০ সালের আগষ্ট পর্যন্ত) নিখোঁজ হওয়া ৬০৪ জনের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন। অন্যরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন তার কোনো তথ্য নেই পরিবারের কাছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও দিতে পারছে না কোনো তথ্য। এর মাধ্যমে সমাজে একটি ভয়ার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান মানবাধিকারকর্মীরা।
তারা আরও জানান, এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনীতির বাইরেও ঘটছে এমন অসংখ্য নিখোঁজের ঘটনা।
অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত খুন ও হেফাজতে নির্যাতন ও ন্যায়বিচারের সুযোগহীনতার মতো বিষয়গুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতা ও চরম অপরাধগুলোর অন্যতম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয় না, বরং পরস্পর সম্পৃক্ত; একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে এবং চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনকে বিপন্ন করে তোলে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য গুমকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ আগে যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্টে, বাসে, ট্রেনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো, তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এমন কোনো আলোচনা হতে দেখি না। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে গুমের মত ঘটনা এমন একটা অবস্থায় মানুষকে নিয়ে গিয়েছে মানুষ আর এখন নিজেকে নিরাপদ ভাবছে না।
আইনজ্ঞরা বলছেন, যদি কোনো ব্যক্তি সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, যদি কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস বা কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার বিব্রত হয়, তাহলে তাকে সতর্ক করা কিংবা তাকে শাস্তি দেয়ার আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে এবং তার দল ও মত যাই হোক, তার বিচারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এমনকি, তাকে জিজ্ঞাসাবাদেরও আইন রয়েছে। কিন্তু এরপরও কেন মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ‘নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। নিখোঁজের কোনো অভিযোগ আসামাত্র তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। নিরপেক্ষভাবে তার তদন্ত করতে হবে। ভিকটিম পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থানের বিষয়ে জানাতে হবে।’
তারা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
আরও বলেন, সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।
তারা বলেন, গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৬
আপনার মতামত জানানঃ