বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি ছড়ানোর পর সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি বহুবার নিজের রূপ পাল্টেছে। ইতোমধ্যেই দেশে বিভিন্ন সময়ে নমুনার সিকোয়েন্সিং করে পাওয়া গেছে নানা রকমের ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি। সম্প্রতি সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অধিকাংশ নমুনায় ভারতের ভ্যারিয়েন্ট বলে পরিচিত ডেল্টার (B.1.617.2/AY.1/AY.2/AY.3/AY.3.1) উপস্থিতি। তবে এরই মধ্যে পেরুর ভ্যারিয়েন্ট বলে পরিচিত ল্যাম্বডাও (C.37) পাওয়া গেছে বাংলাদেশে। যা পেরুসহ বিশ্বের ২৮টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা (জিআইএসএআইডি) থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সেখানে জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য আপলোড করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। জিনোম সিকোয়েন্স যৌথভাবে করেছে বিসিএসআইআর এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
জিনোম সিকয়েন্সের তথ্য থেকে জানা যায়, রাজধানীতে ৪৯ বছর বয়সী একজন নারীর নমুনা সিকোয়েন্সিং করে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মার্চ মাসে সংগ্রহ করা নমুনায় ল্যাম্বডার উপস্থিতি পাওয়া যায় বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বেশিরভাগ মিউটেশনের ফলে ভাইরাসটির মূল গঠনের ওপর খুব কম বা একেবারেই কোনও প্রভাব পড়ে না। সময়ের সঙ্গে এটি বিলুপ্তও হয়ে যায়। কিন্তু কোনও কোনও মিউটেশন এমনভাবে ঘটে, যা ভাইরাসটিকে টিকে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ইতোমধ্যেই দেশে বিভিন্ন সময়ে নমুনার সিকোয়েন্সিং করে পাওয়া গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট বলে পরিচিত আলফা (B.1.1.7), দক্ষিণ আফ্রিকার বেটা (B.1.351), ব্রাজিলের গামা (P.1)। তবে ডেল্টাসহ চারটি ভ্যারিয়েন্টকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন বলে ঘোষণা করেছে। এছাড়াও দেশে পাওয়া গেছে নাইজেরিয়ার ভ্যারিয়েন্ট বলে পরিচিত ইটা (B.1.525)। ল্যাম্বডার মতো এই ভ্যারিয়েন্টকেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট হিসেবে বিবেচনা করছে এখনও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট তালিকায় থাকা ল্যাম্বডা দ্রুত বিস্তার লাভের ক্ষমতার জন্যই নয়, পেরুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর জন্যেও এটি পরিচিত। এটি বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করছে। এছাড়াও আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া এবং যুক্তরাজ্যসহ কমপক্ষে ২৮টির বেশি দেশে এই ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার তথ্য জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কাতারের দোহা কর্নেল মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রুবায়েত হাসান এক দৈনিককে বলেন, ‘করোনাভাইরাস একটি m-RNA ভাইরাস এবং এটি স্বাভাবিক যে এখানে মিউটেশন হবে। অধিকাংশ মিউটেশনই উদ্বেগের কারণ না হলেও যখন স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশন হয় এবং ভাইরাসের বিপজ্জনক চরিত্রগত পরিবর্তন হয় তখন সেটি বিশাল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিচারে সার্স কোভিড-২ ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্ট এখনও ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ নয়, বরং ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’। এর মানে হলো এসব ভাইরাসের রোগ ছড়ানোর বা গুরুতর রোগ ঘটানোর বা ভ্যাকসিনের সুরক্ষাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবং এসব ভাইরাস বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ ঘটাতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।”
তিনি আর বলেন, ‘ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্ট গত ডিসেম্বরে পেরুতে প্রথম পাওয়া যায় এবং ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়। কিন্তু এখন কমে আসছে। ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপারে তথ্য খুব সীমিত। কিন্তু এর স্পাইক জিনে ডেল্টার মতো একটি মিউটেশন রয়েছে। খুব প্রাথমিক কিছু গবেষণায় এর সংক্রমণ করার ক্ষমতা বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু খুব কম সংখ্যায়। ডেল্টার মতো ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েনি এখনও।’
এর আগে পেরুর কায়েটানো হেরেডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পাবলো সুকায়ামা জানিয়েছিলেন, পেরুতে করোনা শনাক্তদের ৮২ শতাংশ ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ১০ শতাংশই মারা যাচ্ছেন। মৃত্যুর হার প্রতি এক লাখ জনে ৬০০ জন।
তিনি বলেন, ‘এ থেকে বোঝা যায় অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ল্যাম্বডা ভারিয়েন্টের সংক্রমণের হার বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আক্রান্তদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ থেকে মনে হচ্ছে, এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের পেটের পীড়া হতে পারে। তবে এটি অনেক বেশি ভ্যাকসিন প্রতিরোধি কি না, সেরকম প্রমাণ খুব কম।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট হিসেবে থাকা চারটি ভ্যারিয়েন্ট হলো- ইটা, আইওটা, কাপ্পা এবং ল্যাম্বডা। যার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে করোনার ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্টের দ্রুত বিস্তার বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শুধু দ্রুত বিস্তার লাভের ক্ষমতার জন্যই নয়, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হারও এই ভ্যারিয়েন্টেই দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো ভাইরাসই ক্রমাগত মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেকে বদলাতে থাকে। ফলে একই ভাইরাসের নানাধরন তৈরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাইরাসের এই পরিবর্তন আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কারণ নতুন সৃষ্ট বেশিরভাগ ভ্যারিয়েন্ট মূল ভাইরাসের চেয়ে দুর্বল এবং কম ক্ষতিকর হয়। কিন্তু কিছু ভ্যারিয়েন্ট আবার অধিকতর ছোঁয়াচে এবং মারাত্মক হয়ে ওঠে। অনেক সময় ভ্যাকসিন দিয়েও একে কাবু করা কঠিন হয়ে পড়ে। করোনাভাইরাসের এমনই একটি ভ্যারিয়েন্টের নাম ল্যাম্বডা।
ল্যাম্বডা আগের সব ভ্যারিয়েন্টের থেকে বেশি মারাত্মক। করোনার এই ভ্যারিয়েন্টের বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে C.37। পূর্বে এটি পরিচিত ছিল আন্দিয়ান স্ট্রেইন নামে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১ সালের ১৪ জুন, এই ভ্যারিয়েন্টের নাম রাখে ল্যাম্বডা।
ভ্যারিয়েন্টটির স্পাইক প্রোটিনের নির্দিষ্ট অস্বাভাবিক মিউটেশনগুলো উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনার এই জিনোমিক পরিবর্তনের পরিপূর্ণ প্রভাব সম্পর্কে বর্তমানে সীমিত প্রমাণ রয়েছে। একই সঙ্গে পাল্টা ব্যবস্থাগুলো ওপর এর প্রভাব ভালোভাবে বুঝতে এবং এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে আরও অধ্যয়নের প্রয়োজন। সুতরাং করোনার ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্ট অধিকতর সংক্রামক কিংবা বিপজ্জনক কি না তা জানতে আসলে আরও অধিক গবেষণা প্রয়োজন।
ল্যাম্বডার স্পাইক প্রোটিনে সাতটি মিউটেশনের একটি অনন্য প্যাটার্ন রয়েছে। যা ভাইরাসটি মানুষের কোষকে সংক্রামিত করতে ব্যবহার করে। সান্টিয়াগোর চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিকা আচেভেদো এবং তার সহকর্মীরা ল্যাম্বাডার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। চীনের ভ্যাকসিন করোনোভ্যাকের দুটি ডোজ নিয়েছেন এমন স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের রক্তের নমুনা ব্যবহার করে তারা গবেষণা করেন। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তাদের করা গবেষণাপত্র একটি প্রি-প্রিন্ট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, করোনার এই ধরণটি আলফা ও গামা ধরনের চেয়েও বেশি সংক্রামক। করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও এই ধরণ ফাঁকি দিতে পারে। গবেষণাপত্রে তারা লিখেছেন, আমাদের ডেটা প্রথমবারের মতো দেখিয়েছে যে, ল্যাম্বডার স্পাইক প্রোটিনে থাকা মিউটেশনগুলো অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে পারে। সেই সঙ্গে সংক্রমণও বাড়ায় এই ধরন।
ব্রাজিলের দক্ষিণের শহর পোর্তো আলেগ্রির একটি হাসপাতালে করোনার এই ধরনে আক্রান্ত এক রোগীকে নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। পিয়ার-রিভিউ করা হয়নি এমন একটি প্রি-প্রিন্ট গবেষণাপত্রে তারা বলছেন, পেরু, ইকুয়েডর, চিলি ও আর্জেন্টিনাতে এই ধরণটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে- তা বিবেচনা করে আমরা বিশ্বাস করি, ল্যাম্বডা নামের এই ধরনটি ‘উদ্বেগের ভেরিয়েন্ট’ হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে পাওয়া ভ্যারিয়েন্টটিকে ল্যাম্বডা বলা হলেও এটিতে তেমন ক্ষতিকর মিউটেশন নেই। এটা একটা স্বস্তির বিষয়। তবে ভ্যারিয়েন্ট যাই হোক না কেন সবাইকে মাস্ক পরে ভ্যাকসিন নিয়ে সংক্রমণ মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১২৩৫
আপনার মতামত জানানঃ