কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে চলা সৌদি সমাজেও শেষ পর্যন্ত পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। আর এই পরিবর্তন আসছে ক্রাউন প্রিন্স মোহামেদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ এর হাত ধরে। ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল ইসলামী দেশ হিসেবেই পরিচিত সৌদি আরব। তবে সম্প্রতিই দীর্ঘদিনের এই গোঁড়ামির খোলস ভাঙতে শুরু করেছে দেশটি। নারীদের উপর থেকে শিথিল হচ্ছে বিধিনিষেধ।
এরই ধারাবাহিকতায় আবারও ইতিহাস গড়ে মক্কা ও মদীনার দুই পবিত্র মসজিদের তত্ত্বাবধানকারী দফতর রিয়াসা শুউন আল-হারামাইনের সহকারী প্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো দুই নারীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এমনিতে সৌদিতে প্রায়শই নারীদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। নানান বেড়াজালে আটকে থাকেন দেশটির নারীরা। তবে সেই গোঁড়া মানসিকতায় পরিবর্তন করে দেশে আধুনিকতা ছড়িয়ে দিতে চাইছেন সৌদির যুবরাজ প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমন।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম আরব নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোববার রিয়াসা শুউন আল-হারামাইনের প্রধান ও মক্কার মসজিদুল হারামের ইমাম শেখ আবদুর রহমান আল-সুদাইস এই নিয়োগ দেন।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ড. ফাতেমা আল-রাশুদকে দফতরের নারী বিষয়ক সহকারী প্রধান ও ড. আল-আনুদ আল-আবুদকে নারী উন্নয়ন বিষয়ক সহকারী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
রিয়াসা শুউন আল-হারামাইন আরো জানানো হয়, দুই পবিত্র মসজিদে আসা নারী জিয়ারতকারীদের সেবার মান বাড়াতে তারা ৩২০ সৌদি নারীকে প্রশিক্ষণ দিতে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদীনার মসজিদে নববী, দুই পবিত্র মসজিদের যাবতীয় বিষয় স্বতন্ত্রভাবে তত্ত্বাবধানের জন্য ২০১২ সালে রিয়াসা শুউন আল-হারামাইন দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এর আগে গত বছরের আগস্টে প্রথম রিয়াসা শুউন আল-হারামাইনের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ে ১০ নারীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এছাড়া গত এপ্রিল থেকে মক্কা এবং মদিনায় নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থায় একাধিক নারী সেনা যোগ দিয়েছেন। তাদের অনেকেই এবার ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের পবিত্র তীর্থক্ষেত্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন।
পাশাপাশি এবারই প্রথমবার হজের সময় মক্কায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকলেন সৌদি নারী সেনারা। বর্তমানে ১৮ সদস্যের মোট চার নারী সৈনিকের দল চার শিফটে মসজিদুল হারামে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
সৌদির যুবরাজ প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমনের সংস্কারের পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০৩০’ অনুযায়ী, নারীদের গাড়ি চালানোর উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের যাতায়াতের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে সৌদি সরকার। পরিবারেও নারীদের আরও ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যদিও অভিযোগ, বিদেশি বিনিয়োগ টানতেই এসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
পাশাপাশি পুরুষের কর্তৃত্ব থেকে নারীকে মুক্ত করার এক যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। দেশটির শরিয়া আদালতের ১৬৯ ধারার ‘বি’ অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছে। ওই বিধান অনুসারে অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত ও প্রাপ্ত বয়স্ক বিধবা মহিলাদের অবশ্যই একজন পুরুষ অভিভাবকের হেফাজতে থাকতে হতো। তবে এখন থেকে সৌদি আরবে অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবা মহিলারা বাবা বা অন্য কোন পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পছন্দের বাড়িতে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারবে।
এমনকি কিছুদিন আগেও সৌদি নারীদের পুরুষ অভিভাবক অর্থাৎ কারো স্ত্রী, মা, বোন ইত্যাদি পরিচয় নিয়েই তবে হজের জন্য নিবন্ধন করতে হতো। তবে এখন পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই হজের জন্য নিবন্ধিত হতে পারবেন দেশটির নারীরা। সময়ের সাথে ধর্মীয় বিধিনিষেধ শিথিল হচ্ছে সৌদিতে।
সৌদি আরবে বহু দশক ধরে এমন পদ্ধতি চালু ছিল যে নামাজের জন্য আজান শোনামাত্রই বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে ফেলত। নামাজের সময় সারি সারি গাড়িগুলোকে পেট্রোল পাম্পের সামনে অপেক্ষা করতে হতো তেল নেয়ার জন্য।
কারণ নামাজ শেষে পেট্রোল পাম্পের কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়া ফার্মেসি, রেস্টুরেন্ট ও সুপার মার্কেটগুলোর ক্রেতা ও বিক্রেতাদের অপেক্ষা করতে হতো নামাজ শেষ হওয়ার জন্য। কিন্তু সে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ নামাজের সময়ও দোকান খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ