করোনা মহামারিতে অনেক যৌনকর্মীই কাছ ছেড়েছেন, আবার কাজ হারিয়ে নিম্ন আয়ের নারীদের কেউ কেউ এই পেশায় জড়িয়েও পড়ছেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারতে দৈনিক সংক্রমণ চার লাখ ছাড়িয়ে গেলেও সেই অর্থে আক্রান্ত হননি দেশটির যৌনকর্মীরা৷ ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তারই পেছেনের গল্প।
সোনাগাছির রাস্তাটা আজন্মকাল সন্ধার দিকে একেবারে অন্য চেহারায় থাকে; যদিও এখন বদলেছে রঙ। জায়গায় জায়গায় জটলা এখনো আছে। যৌনকর্মীদের প্রসাধনীর বাড়বাড়ন্ত, খরিদ্দারদের উৎসুক চোখ, কথার সাথে কথার ধাক্কাধাক্কি, আলো-আঁধারি, অযথাই গায়ে পড়া, স্বাস্থ্যবিধির আগাপাশতলা এখানে খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টের।
তবে করোনায় বদলে গেছে সোনাগাছির জীবন। একের পর এক গলির মুখে ছোট ছোট হেল্প ডেস্ক৷ থার্মাল স্ক্যানার নিয়ে বসে আছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা৷ হেল্প ডেস্কে থার্মাল স্ক্যানারে মেপে নেওয়া হচ্ছে খরিদ্দারের তাপমাত্রা৷ সামান্য সর্দি-কাশির আভাস পেলেও তাকে চলে যেতে বলা হচ্ছে৷ একেকটি ঘরে ঢোকার মুখে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে কাস্টমারদের৷
যৌনকর্মীদের মুখে ডাবল মাস্ক, কাস্টমারদের বাধ্য করা হচ্ছে ডাবল মাস্ক পরতে৷ কিছুক্ষণ পর পরই পকেট থেকে স্যানিটাইজার বার করে হাতে লাগিয়ে নিতে ভুল করছে না কেউ। ঘরের ভিতরেও মাস্ক খুলতে দিচ্ছেন না; নিজেরাও খুলছেন না৷ আগেই এ কথা জানিয়ে দিচ্ছেন কাস্টমারদের।
খাতায় কলমে এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি কলকাতার সোনাগাছি৷ শতক পুরনো এই রিপুমহলে এখন বাস করেন প্রায় সাত হাজার যৌনকর্মী এবং তাদের পরিবার৷ এছাড়াও রয়েছে ভাসমান যৌনকর্মীরা৷ যারা সোনাগাছিতে থাকেন না কিন্তু কাজের সূত্রে আসেন৷ সেই সংখ্যা হিসেব করলে মোট যৌন কর্মীর পরিমাণ ১৫ হাজারের কাছাকাছি৷
আশ্চর্য বিষয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সেই সোনাগাছি সামলে নিয়েছে৷ মৃত্যু হয়নি একজনেরও৷ সব মিলিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ শতাংশেরও কম যৌনকর্মী৷ কিছুদিন আগে করোনাতে মারা যাওয়া বিশিষ্ট চিকিৎসক স্মরণজিৎ জানার ভূমিকা এখানে না বললেই নয় এই চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি কাজ করেছেন৷
কিছুদিন আগে সাংবাদিককে বলছিলেন, ”করোনার প্রথম ঢেউয়ে সম্পূর্ণ লকডাউনে ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল সোনাগাছির যৌনকর্মীদের৷ বোঝা যাচ্ছিল ফের লকডাউন হলে তারা না খেতে পেয়ে মরে যাবে৷”
তাই টিকা আসার পরেই দ্রুত যৌনকর্মীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেম এই চিকিৎসক৷ পাশাপাশি শুরু হয় সচেতনতা শিক্ষা৷ এনজিও দুর্বার যারা ভারতের যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে, তারা ঘরে ঘরে সচেতনতামূলক লিফলেট বিলি করতে শুরু করে৷ যৌনকর্মীদের বোঝানো হয়, ব্যবসা করলেও কীভাবে দূরত্বের কথা মাথায় রাখতে হবে৷ মুখ থেকে মাস্ক খোলা যাবে না৷ কীভাবে নিজেদের স্যানিটাইজ করতে হবে৷ এরপরেই গোটা সোনাগাছি জুড়ে বেশ কিছু হেল্প ডেস্ক তৈরি করে দুর্বার৷ খরিদ্দারদের পরীক্ষা শুরু হয়৷
দুর্বারের সম্পাদক কাজল বসু বলেন, ”ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতোই সমস্ত কাজ করেছি আমরা৷ তাতে লাভও হয়েছে৷ যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের কড়া আইসোলেশনে রাখা হয়েছে৷ সোনাগাছির মতো ঘিঞ্জি জায়গায় একবার করোনা ছড়িয়ে গেলে ভয়ংকর ব্যাপার হতো৷”
দীর্ঘদিন ধরে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানান, ”খুব সতর্কভাবে সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ সরকারও খুব সাহায্য করেছে৷ সে কারণেই সময় মতো সকলকে টিকা দেওয়া গেছে৷ ব্যবসা বন্ধ না করেও যে সতর্কতা অবলম্বন করা যায়, সোনাগাছি এবারে তা দেখিয়ে দিয়েছে৷”
শুধু সোনাগাছি নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত যৌনপল্লিতেই একই নিয়ম পালন করেছেন যৌনকর্মীরা৷ ফলও পেয়েছেন৷ তবে বাকি ভারতের চেহারা অবশ্য এক নয়৷ দিল্লিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে কাজ বন্ধ হয়ে যায় যৌনকর্মীদের৷ অনেকে দেশের বাড়ি ফিরে গেছিলেন; যারা বাড়ি ফিরতে পারেননি, তারা পরিচিত কাস্টমারদের বাড়ি গিয়ে অথবা হোটেলে গিয়েছেন৷
যৌনকর্মীর বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দিল্লিতে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা এক এনজিও কর্মী৷ তবে গত একমাসে দিল্লির যৌনকর্মীদেরও টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে৷ জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে তারা কাজও করতে শুরু করেছেন৷
এদিকে, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, দিনমজুর, গৃহকর্মীদের উপার্জন নেই৷ কিন্তু যৌনকর্মীদের অবস্থা কী? করোনা এমন এক রোগ, যা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে এই পেশায়৷ স্বাভাবিক সময়ে অনেকে নিজের জন্য সঞ্চয় রেখে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারতেন বলে বিভিন্ন এনজিওকে জানিয়েছেন৷ কিন্তু করোনাকালে খদ্দের একেবারে কমে যাওয়ায় নিজেরাই এখন না খেয়ে থাকেন৷
অনেকে বাসা ভাড়া না দিতে পেরে যৌনপল্লি ছেড়ে দিচ্ছেন৷ কিন্তু যারা এই কাজে এতদিন থেকেছেন করোনার এই সময়ে কি কাজ করবেন তারা! তাই তাদের কেউ কেউ হয়েছেন ভাসমান যৌনকর্মী৷ দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি দৌলতদিয়ায়৷ এখানে স্বাভাবিক সময় প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী থাকেন৷ বর্তমানে এক হাজার ৫০ জনের মতো যৌনকর্মী রয়েছেন৷
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল এইডস অ্যান্ড এসটিডি কর্মসূচির আওতায় ২০১৫ সালে এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে নারী যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ২৬০৷ এর পাশাপাশি আছেন লক্ষাধিক পুরুষ ও ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মী৷ দেশের যৌনপল্লিগুলোতে যৌনকর্মীর সংখ্যা চার হাজারের মতো৷ আর বাকিরা ভাসমান বা হোটেল ও বাসাবাড়িতে কাজ করেন৷
করোনা ভাইরাসের টিকা নেয়া নিয়ে যৌনপল্লির বাসিন্দাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে৷ অনেকের টিকার প্রতি আস্থা নেই বলে জানিয়েছেন সেখানকার একজন জনপ্রতিনিধি৷ তবে টিকা নেয়ার পক্ষেও রয়েছেন কেউ কেউ৷ তবে যৌনমকর্মীদের টিকাদানে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।
লকডাউনের সময় দেশের ১১ যৌনপল্লির বাসিন্দাদের সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হয়েছিল৷ তবে তা ছিল খুবই অপ্রতুল৷ অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং অধিকার নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন লাইট হাউস৷ প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের জুন মাসে দেশের ২৫টি জেলায় নারী যৌনকর্মী ও ট্রান্সজেন্ডারদের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে৷ সেখানে দেখা যায়, তাদের কাজ ৭৭ শতাংশ কমে গেছে৷ নারী যৌনকর্মীদের আয় কমে গেছে ৭৩ শতাংশ৷
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ছোট আকারে ৪০০ যৌনকর্মীর ওপর ফলোআপ জরিপ করে লাইট হাউস৷ সেখানে দেখা যায়, দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর ১৬ শতাংশ নারী যৌনকর্মী একেবারে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন৷ এর আগে পাঁচ শতাংশ যৌনকর্মীর মাসিক আয় এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে ছিল৷ দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর ৫২ শতাংশ যৌনকর্মীর আয়ের অবস্থা এমনটা দাঁড়ায়৷ সরকারের অপ্রতুল সাহায্য করোনা মহামারিকে ক্ষুধার মহামারিতে বদলে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ