শেষ সম্বল বিক্রি করে সৌদি আরবে পাড়ি জমানো বাংলাদেশি নারীরা সৌদি নিয়োগকর্তার লিপ্সার শিকার হওয়ার পাশাপাশি স্বদেশিদেরও যৌনলিপ্সার শিকার হচ্ছেন খোদ দূতাবাসের ভেতরেই। যে দূতাবাস সার্বভৌমত্বের প্রতীক, বিদেশ-বিভুঁইয়ে এক টুকরো বাংলাদেশ সেখানেই তারা সম্ভ্রম হারিয়ে দেশে ফিরছেন। এমন ঘটনা বিরল কিছু নয়। একজন বা দুজন নয়, একাধিক নারী একই কর্মকর্তার কাছে যৌননিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
সম্প্রতি ৯ জন নারী তাদের দুর্দশার কথা তদন্তদলের কাছে তুলে ধরেছেন। তাদের বাইরেও আরও নারী থাকতে পারেন, যারা তার হাত থেকে রেহাই পাননি। এমনটাই মনে করছেন এ ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত জনপ্রশাসন ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
তারা জানিয়েছেন, সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠাতে বাংলাদেশে এক ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে। দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ধারা অব্যাহত রাখতে এসব প্রচারণা আমলে না নিয়ে সরকার দেশটিতে নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে পাঠাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের কর্মকর্তাদের উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। কিন্তু উল্টো রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
রক্ষকই যখন ভক্ষক
দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমনই এক ভক্ষকের নাম মো. মেহেদী হাসান। প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তা বর্তমানে উপসচিব। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সিলর (শ্রম) পদে নিয়োগ পান ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি। দূতাবাসে আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়া অল্পবয়সী গৃহকর্মীদের টার্গেট করতেন তিনি। তাড়াতাড়ি দেশে ফেরত পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতেন। যারা রাজি হতেন না তাদের সেইফহোমে রেখেই রাজি করানোর চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন উপলক্ষে উপহারসামগ্রী পাঠাতেন। তারপরও সম্পর্ক স্থাপনে রাজি না হলে জোর করতেন। এসব কাজের জন্য তিনি অফিস-পরবর্তী সময় বেছে নিতেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য তিনি বিকেল ৫টার পর আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়া নারীদের ডেকে পাঠাতেন।
দূতাবাসের থার্ড লেবেলের কর্মকর্তা হয়েও তিনি নিজস্ব একটা নিয়মকানুন তৈরি করেছিলেন। একমাত্র তার অনুমতি ছাড়া কোনো গৃহকর্মী বাংলাদেশে ফিরতে পারবে না এ ধারণার জন্ম দিয়ে ভীতিসঞ্চার করতেন। তিনি যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য অপ্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার প্রথা চালু করেন। তার এসব অনিয়ম প্রমাণ করতে না পারলে চাকরি হারাবেন এ ভয়ে অধীনস্থ কর্মচারীরাও চুপ থাকতেন। কিন্তু তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় এক গৃহকর্মীর সাহসে।
ওই গৃহকর্মী তার ধর্ষণের কাহিনী ফাঁস করে দেওয়ার পর তদন্তে নামে দূতাবাস প্রশাসন। রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর কড়া নির্দেশনায় যে রাতে ওই নারী ধর্ষণের শিকার হন সে রাতেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন তদন্তকারীরা। নিপীড়নের শিকার অন্য নারীদের জবানবন্দিও নেন তারা। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৬ জানুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠান তদন্তকারীরা। পরে অভিযুক্ত মেহেদী হাসান ছাড়াও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবানবন্দি নিয়ে গত ২৬ জানুয়ারি তারা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাঠান ঢাকায়।
তদন্ত করেছেন বাংলাদেশ দূতাবাস রিয়াদের মিনিস্টার ও কার্যালয় প্রধান ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ এবং দূতাবাসের ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাঈদ সিদ্দিকী। তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত পোষণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন রাষ্ট্রদূত ড. জাবেদ পাটোয়ারী।
পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর মেহেদী হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিভাগীয় মামলা চালু করে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবু আহমদ সিদ্দীকীকে। তিনি অভিযোগ দায়েরকারী প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং অভিযুক্ত মেহেদী হাসানকে তলব করেছিলেন গত ২৭ জুলাই।
যা ঘটেছিল ওই গৃহকর্মীর সাথে
ধর্ষণের শিকার গৃহকর্মী গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আশ্রয়ের জন্য রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে যান। তিনিসহ চারজন দূতাবাসে গৃহকর্মীদের অপেক্ষমাণ কক্ষে সেদিন বসেছিলেন। বিকেল ৫টার পর মেহেদী হাসান তাদের সাক্ষাৎকার নেন। একে একে তিনজনের সাক্ষাৎকার শেষে তাদের বের করে দিয়ে চতুর্থ জনের সঙ্গে একান্তে আলাপ শুরু করেন তিনি। ওই গৃহকর্মী দুই বছর চার মাস আগে সৌদি আরব গেছেন। দুই বছরের চুক্তি ছিল, যা শেষ হওয়ার পরও কফিল (নিয়োগকর্তা) তাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছেন না। তাই দেশে ফেরার ব্যবস্থা করার জন্য দূতাবাসে যান তিনি।
সাক্ষাৎকারের সময় মেহেদী গৃহকর্মীর কাছে জানতে চান, ‘দেশে যেতে টাকা লাগবে, আছে?’ জবাবে গৃহকর্মী জানান, তার কাছে টাকা নেই। তখন মেহেদী বলেন, একটা সুযোগ আছে। তার সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। এ প্রস্তাব শুনে ওই গৃহকর্মী বের হয়ে যান। কয়েক দিন পর তাকে পুনরায় মেহেদী হাসানের অফিস কক্ষে ডেকে নেওয়া হয়। ওইদিনও মেহেদী হাসান তাকে জোরাজুরি করেন।
গত ১৪ জানুয়ারি ফ্লাইটের ডেট থাকায় ১৩ জানুয়ারি ওই গৃহকর্মীর করোনা টেস্ট হয়। করোনা টেস্টের পর পাঁচজনকে সন্ধ্যা ৬টায় মেহেদী হাসানের অফিস কক্ষে নেওয়া হয়। অপর চারজনের সঙ্গে কথা বলে তিনি তাদের বিদায় করে দেন। ফ্লাইটে ওঠার আগের রাতে ওই গৃহকর্মীকে জোর করে যৌন নির্যাতন করেন মেহেদী হাসান। ঘটনার পর দূতাবাস থেকে সেইফহোমে যাওয়ার জন্য দূতাবাস নির্ধারিত গাড়িতে উঠেই গাড়িচালক জানে আলমকে ধর্ষণের কথা জানান নির্যাতিতা নারী।
একই দিনে তদন্তদলকে অপর গৃহকর্মী জানান, মেহেদী হাসান তার মোবাইলের পাসওয়ার্ড খুলে দিতে বলেন। এসময় মেহেদী ওই গৃহকর্মী ও তার স্বামীর একান্ত ব্যক্তিগত ছবি দেখেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি ছবিগুলো জুম করে দেখেন। একপর্যায়ে মেহেদীর কথামতো কাজ করতে বাধ্য হন গৃহকর্মী।
তৃতীয় গৃহকর্মী জানান, তাকে রুমে ডাকা হয়। ভেতরে যাওয়ার পরই তার ফোন নেওয়া হয়। একইসঙ্গে জানতে চান, কফিল বা অন্য কেউ ধর্ষণ করেছে কি না। মেহেদী তাকে তার বুক দেখাতে বলেন। তদন্তকারীদের এক গৃহকর্মী জানান, মেহেদী তার পেট দেখতে চাইলে তিনি পেট দেখান। অপরজন জানান, তিনি পেট দেখাননি।
একমাত্র তার অনুমতি ছাড়া কোনো গৃহকর্মী বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন না এ ধারণার জন্ম দিয়ে ভীতিসঞ্চার করতেন মেহেদী হাসান। গৃহকর্মীদের ভয় দেখিয়ে, গণহারে অশ্লীল প্রশ্ন করে যৌন নির্যাতন করতেন এবং ধর্ষণের টার্গেট নির্ধারণ করতেন। এসব প্রমাণিত হয়েছে। অশ্লীল প্রশ্ন করা এবং অশালীন আচরণ করা মেহেদীর বিকৃত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মেহেদী তার যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য একান্তে সাক্ষাৎকার নিতেন। মেহেদী শ্রমকল্যাণ উইংয়ের কর্মচারীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করেছিলেন। চাকরি হারানোর ভয়ে কর্মচারীরা বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাননি
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩০৪
আপনার মতামত জানানঃ