রাজধানীর মোহাম্মদপুরের গজনবী রোডে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১-এর ১৫ তলার অর্ধেক জুড়ে আছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে। তার মধ্যে রয়েছে ছয়টি বেসরকারি হাসপাতাল। কোনও হাসপাতালে ১০ বেড, আবার কোনোটার আছে ২০ বেড। একটি হাসপাতালে শুধু অপারেশন থিয়েটার ভাড়া দেওয়া হয়। এদিকে, জনবল কম এই অজুহাতে উদ্বোধনের ১৫ বছরেও চালু হয়নি তিন সরকারি হাসপাতাল। এই নিয়ে উদাসীন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতাল ছাড়াও এই ভবনে আছে ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টার, ফার্মেসি, হেয়ারিং সেন্টারসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা পেলেও করোনা রোগীদের চিকিৎসা এখানে হয় না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র মতে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য বহুতল এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১। প্রকল্পের উদ্যোক্তা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদফতর ও স্থাপত্য অধিদফতর।
প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করা হয় ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে। এর আগে এটি দোতলা একটি পুরনো ভবন ছিল। নির্মাণ কাজ শেষে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, টেন্ডারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক অংশ ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এখান থেকে অর্জিত আয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট একটি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে— এমন ধারণা থেকেই ভাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
চার ফ্লোরে ছয় বেসরকারি হাসপাতাল
১৫ তলা এই ভবনে ২টি বেজমেন্ট আছে, সেখানে রয়েছে ৮০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় ৭৪টি দোকানের জায়গা রাখা হয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম তলাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।
দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোরে হাসপাতাল আছে ছয়টি। এসব হাসপাতালের ব্যবহৃত জায়গা খুবই ছোট এবং এক ফ্লোরে একাধিক হাসপাতাল, কিংবা দুই ফ্লোরের এক-এক জায়গা মিলে এক-একটি হাসপাতাল করা হয়েছে। আবার কেউ মাত্র ৭০০ বর্গফুট জায়গায় হাসপাতাল করেছেন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ১০ বেডের অনুমোদন তাদের কাছে আছে, আবার কারও কারও ২০ বেডের অনুমোদন থাকলেও সেটার মেয়াদ শেষ হয়েছে এক মাস আগেই। দেখা গেছে, একই হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিট রয়েছে বিভিন্ন ফ্লোরে। কোনও কোনও ফ্লোরে তিনটি হাসপাতালের শাখা আছে।
এই টাওয়ারের ৪টি ফ্লোরে থাকা হাসপাতালগুলো হচ্ছে— যমুনা জেনারেল হাসপাতাল, রয়্যাল মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ঢাকা হেলথ কেয়ার হসপিটাল, লাইফ কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল, রেমেডি কেয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, প্রাইম অর্থপেডিক ও জেনারেল হাসপাতাল।
এতগুলো হাসপাতাল থাকায় কোনও রোগী মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে প্রবেশের পর স্বাভাবিকভাবেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে পারেন যে, তিনি কোন হাসপাতালে যাবেন। বিশেষ করে পূর্ব পরিচিত না হলে, কিংবা কেউ রেফার না করলে এখানকার হাসপাতাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া খুব মুশকিলের কাজ।
ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন জানান, তারা টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসেছেন চিকিৎসার জন্য। অন্য প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ বেশি হওয়ায় এখানে এসেছেন। তবে হাসপাতালে প্রবেশের আগে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার কথাও জানান তিনি।
যমুনা জেনারেল হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের হাসপাতালে আছে মাত্র ২০টি বেড এবং আইসিইউ সুবিধা। তবে করোনার কারণে আইসিইউ সেবা বন্ধ রেখেছেন তারা। এখানে মূলত অর্থোপেডিক সমস্যার রোগীরাই আসেন চিকিৎসা নিতে। হাসপাতালটি প্রায় ৩ বছর ধরে চালু রয়েছে। এছাড়া অপারেশন থিয়েটার সুবিধাও আছে এখানে।
নাম প্রকাশ না করে হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা জানান, এখানে কম খরচে রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। বেড ভাড়া প্রতিদিন ১২০০ টাকা। হাসপাতালের অনুমোদন আছে কিনা— প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, জুন মাসে মেয়াদ শেষ হয়েছে। আমরা আবেদন করেছি কিন্তু এখনও পাইনি।
যমুনা জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে একই ফ্লোরে রয়েছে রয়্যাল মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখানেও রোগীদের যাবতীয় টেস্টের পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তারাও কয়েকটি ফ্লোরের এক-একটি অংশ ভাড়া নিয়ে হাসপাতাল পরিচালনা করছেন। এই হাসপাতালের প্রধান শাখা বাবর রোডে বলে জানান দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে তাদের দ্বিতীয় ইউনিট।
চতুর্থ তলায় একটি ফ্লোর-জুড়ে আছে ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ফার্মেসি, ল্যাবরেটরি টেস্ট এবং আইসিইউ সুবিধা আছে। হাসপাতালটির কর্মকর্তারা জানান, কম খরচেই চিকিৎসা সেবা পান এখানে আগত রোগীরা। তবে আইসিইউ সুবিধা যাদের লাগে, তাদের প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানান তারা।
হেলথ কেয়ার হাসপাতালের ম্যানেজার লুৎফর রহমান বলেন, ‘এই ভবনের ভাড়া তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় কম খরচে হাসপাতাল পরিচালনা করা যায়। এখানে যে পরিমাণ জায়গা আছে, অন্যখানে তা ভাড়া নিলে ৪-৫ গুণ বেশি টাকা লাগতো।’
তবে এসব হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন জানান, মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে হাসপাতাল অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মতো হয়ে গেছে। হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর সঙ্গে স্বজনদের থাকার তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। দোকানের জন্য বরাদ্দ রাখা ফ্লোরে রোগীর স্বজনরা রাত কাটান।
ভবনের তৃতীয় তলায় লাইফ কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল। তারা মূলত অপারেশন থিয়েটার সাপোর্ট দিয়ে থাকেন। লাইফ কেয়ারের মালিক জানান, অপারেশন থিয়েটারের চার্জ খুবই কম রাখা হয়। এখানে কোনও রোগীর এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন সবমিলিয়ে খরচ পড়ে ১৭ হাজার টাকার মতো। তাছাড়া এই হাসপাতালের ১০টি বেডের অনুমোদন আছে বলেও জানান তিনি।
তৃতীয় তলায় আরও দুইটি হাসপাতালের ইউনিট রয়েছে। একটি হচ্ছে রয়্যাল মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং রেমেডি কেয়ার হাসপাতাল লিমিটেড। এছাড়া দ্বিতীয় তলার ফ্লোরে আছে প্রাইম হাসপাতাল।
১৫ বছরে চালু হয়নি ৩ সরকারি হাসপাতাল
এদিকে, বগুড়ার সান্তাহার, নন্দীগ্রাম ও শিবগঞ্জের আলিয়ারহাটে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২০ শয্যার তিনটি হাসপাতাল গত ১৫ বছরেও চালু হয়নি। লাখ লাখ টাকার মেশিন বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে। কবে নাগাদ হাসপাতাল চালু হবে নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ।
জেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০০২ সালে নন্দীগ্রামে ২০ শয্যার হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করা হয়। তিন কোটি ২৬ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৮ টাকা ব্যয়ে নির্মাণের পর ২০০৬ সালে উদ্বোধন করা হয়।
প্রায় একই সময়ে আদমদীঘির সান্তাহারে ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় তিন কোটি ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৪৮৮ টাকা। পাশাপাশি শিবগঞ্জ উপজেলার আলিয়ারহাটে ২০ শয্যার হাসপাতালে নির্মাণে ব্যয় হয় চার কোটি ৩২ লাখ টাকা। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হলেও গত ১৫ বছরে হাসপাতালটি চালু করা হয়নি।
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হলেও গত ১৫ বছরে হাসপাতালটি চালু করা হয়নি। হাসপাতালগুলো চালু না হওয়ার জন্য জনবল বরাদ্দ না দেওয়াকে দায়ী করছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২২
আপনার মতামত জানানঃ