‘উন্নত জাতের ঘাস’ চাষ শিখতে ৩২ কর্মকর্তার বিদেশ যাত্রার প্রস্তাব করা হয়েছে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে। ‘প্রাণীপুষ্টির উন্নয়নে উন্নত জাতের ঘাসের চাষ সম্প্রসারণ ও লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর’ শীর্ষক প্রকল্পে এ প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পে এ খাতে অর্থবরাদ্দ দাবি করা হয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রত্যেক কর্মকর্তার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ টাকা করে।
আগামী ২৪ নভেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপন করা হচ্ছে ১০১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার প্রকল্পটি। এপ্রকল্পে উদ্ভট বিদেশ সফরের প্রস্তাবনা ছাড়াও অডিও, ভিডিও ও চলচ্চিত্র নির্মাণে চাওয়া হয়েছে ২০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনে এটি বাধার মুখে পড়তে পারে।
তবে সম্প্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এমনই এক প্রকল্পে অযৌক্তিক বিদেশ সফরের প্রস্তাবে প্রথমে বিরোধিতা করেও পরে সাঁয় দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ওই প্রকল্পে নদী ভাঙন ঠেকাতে বিদেশ সফরের জন্য সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে বাধা দেয় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কমিশনের কর্তাদের সংশ্লিষ্টরা বুঝাতে সক্ষম হন যে, বিদেশ যাওয়া আবশ্যক। সেই মোতাবেক বিদেশ সফরের ব্যয় দেড় কোটি টাকা কমিয়ে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটলে সেটা হবে হতাশাজনক।
এর আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশ সফরের ব্যবস্থা থাকায় ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন সময় পুকুর খনন শেখা, খাল খনন, মৎস্য চাষ প্রযুক্তি হস্তান্তর, কাজুবাদাম চাষ, সড়ক উন্নয়ন এবং সুউচ্চ বিল্ডিং দেখতে বিদেশ সফরের প্রস্তাবও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের তাতে হুঁশ হয়নি। একই পথে হাঁটছেন তারা।
অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। তারা বলছেন, আশেপাশের দেশগুলোর ঘাস উৎপাদন পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া দেখতে এই সফরের প্রয়োজন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরণের প্রস্তাবের ফলে প্রকল্পগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ থেকে যায়। ফলে ভালো ও দরকারি উদ্যোগও সমস্যায় পড়ে। যেসব প্রকল্পে সত্যিকারার্থেই বিদেশ সফর প্রয়োজন, সেগুল নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়। বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিক ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেছেন, ঘাসের চাষ শিখতে বিদেশ সফরের আয়োজন হাস্যকর। এ ধরনের ব্যয় প্রস্তাবে প্রশ্ন থেকে যায়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, ঘাস চাষ এমন কোনো প্রযুক্তিগত বিষয় নয় যে, বিদেশ যেতে হবে। বরং এই টাকা গবেষণায় ব্যয় করলে দেশ আরও উপকৃত হতো। তাছাড়া যারা চাষ দেখে আসবেন তারা হয়তো বদলি হয়ে যাবেন। কিংবা এই সফরে অপ্রয়োজনীয় অনেক কর্মকর্তাই হয়তো থাকবেন। তাই উন্নয়ন প্রকল্পে এ রকম ব্যয় বাদ দেয়া বাঞ্ছনীয়।
‘যারা এই সফরে যাবেন তাদের আদৌ এত টাকা খরচ করে বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। তাছাড়া ১০১ কোটি টাকার প্রকল্পে ৩ কোটি টাকার বেশি শুধু বিদেশ সফরেই যদি ব্যয় হয় তাহলে মূল প্রকল্পের কি অবস্থা হবে? শতাংশের হিসাবে এই টাকা হয়তো বড় কিছু নয়, কিন্তু অঙ্কের দিক থেকে তো অনেক বেশি’, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এমনই প্রশ্ন রেখেছেন আলতাফ হোসেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে কৃষি গবেষণা সংক্রান্ত বেশকিছু দায়িত্বশীল ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। উন্নত ঘাসের চাষ আবিষ্কার করাটা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটি জটিল কোনো কারিগরি প্রকল্প নয় যে, বিদেশ যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করে কি পরিমাণ আর্থিক লাভ পাওয়া যাবে তার হিসাব করা উচিত।
মিই/আরা/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ