এক দশক ধরে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে যাচ্ছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা গেলেও কাজে লাগানো যায়নি বিদ্যুৎ। ফলে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা ও উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে। এর উপর মহামারীকালে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ও উৎপাদনের অসামঞ্জস্যতা বাড়ছে প্রতিদিনই। সক্ষমতার বড় একটি অংশ অব্যবহৃত থেকে যাওয়ায় আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের বিদ্যুৎ খাত।
পরিকল্পনার গোড়ায় গলদ
দেশে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল ২৭ টি। ২০২০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৬ টিতে। অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০২০ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে (+)১১৯ টি। যার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫,২৩৫ মেগাওয়াট। যেখানে সর্বোচ্চ উৎপাদন মাত্র ১৩, ৭৯২ মেগাওয়াট (২৭ এপ্রিল, ২০২১)।
এরপরেও একাদশ জাতীয় সংসদে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশে আরও ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এই বরাদ্দে প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ছিল দলটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ এখন চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম।
কিন্তু কাছাকাছি সময়ে বেশ কিছু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির অনুমতি দেয়া হয়েছিল তার একটি বড় অংশ বাদ পড়ছে। রামপাল, পায়রা, মাতারবাড়ি ও বাঁশখালির মতো নির্মাণাধীন বড় প্রকল্পসহ ২১টি কয়লা-ভিত্তিক কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারের অনুমতি পেয়েছিল। তার মধ্যে ১৬টিই বাদ পড়তে পারে।
চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে এবং দরকারের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যমান কেন্দ্রের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরের বেশিরভাগ সময় অলস পড়ে থাকে। অনেক সময় গ্রীষ্মকালে চাহিদা বাড়ার পরও। তার সাথে এখন যোগ হয়েছে অনুমতি দেয়া প্রকল্প বাদ দেয়ার চিন্তা। সবমিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ভুল অনুমানের উপর ভিত্তি করে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া মানে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের বোঝা হয়ে ওঠা। অলস পড়ে থাকা এই কেন্দ্রগুলো থেকে সরকার যে পরিমাণ বিদ্যুৎ নেবে বলে চুক্তি করেছিল সেটি নেয়ার দরকার না হলেও চুক্তি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ঠিকই দিতে হয়েছে।
পরিকল্পনাহীন উন্নয়নে করোনার ধাক্কা
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। অন্যদিকে এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট। সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করা না গেলেও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েই চলেছে সরকার।
মূলত বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোয় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি করা যায়নি। দেশে শিল্প-কারখানার বিকাশের পরিকল্পনা থেকে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও দেশে দৈনিক ৯-১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারের নজির খুব কম। করোনাতে এই অসামঞ্জস্যতা দানবীয় রূপ নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ জুলাই দিনে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ১৪৭ মেগাওয়াট ও রাতে ১৪ হাজার ৯৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। এ প্রাক্কলনের বিপরীতে দিনে সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৮ হাজার ৬৮ মেগাওয়াট ও রাতে ১০ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। সক্ষমতার বিপরীতে দিনে ও রাতে উৎপাদন ছিল যথাক্রমে প্রায় ৩২ ও ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ ওইদিন সক্ষমতার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গড়ে ৩৭ শতাংশ।
পাওয়ার সেলের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি ও যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি উদ্যোগে নয়টি, যৌথ উদ্যোগে তিনটি ও বেসরকারিভাবে ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক আরো নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১৩ হাজার ৬৫৯ মেগাওয়াট।
বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার ২০২০ সালে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট বছরের মধ্যে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বাইরে সরকারি-বেসরকারি এবং আমদানীকৃত বিদ্যুৎসহ গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা ২১ হাজার ৯৭৭ মেগাওয়াট। যার মধ্যে সরকারি উদ্যোগে আসবে ১৩ হাজার ৫৭১ মেগাওয়াট, বেসরকারি খাত থেকে প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট ও আমদানীকৃত বিদ্যুৎ থাকবে দেড় হাজার মেগাওয়াট।
দেশে মহাপরিকল্পনার ভিত্তিতে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে নানা শর্তের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বেড়েছে ভর্তুকির পরিমাণ ও ঋণের বোঝা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সদস্য (উৎপাদন) মো. আশরাফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা প্রতিদিন যে চাহিদা প্রাক্কলন করছি, সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। সরবরাহ ব্যবস্থায় আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। তবে প্রাক্কলনে যে তারতম্য দেখা যায় তার কারণ হলো দেশের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের চাহিদায় ওঠানামা। বিদ্যুতের ব্যবহার কম হওয়ায় দিনের প্রাক্কলনে তারতম্য হচ্ছে। যদিও রাতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক থাকছে।
বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হুসাইন বলেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ানো যাচ্ছে না, তার প্রধানতম কারণ করোনা মহামারী। কোভিডের কারণে শিল্প-কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিদ্যুতের ব্যবহার কম হচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চালন ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় সক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুৎ বিতরণে প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। সব মিলিয়ে প্রাক্কলন করা হলেও সেটি নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছি।
বিদ্যুৎকেন্দ্র আশীর্বাদ না অভিশাপ
সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে আগের অর্থবছরের মার্চ থেকে গত অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিপিডিবির অনুকূলে মোট ৭ হাজার ৯৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ছাড় করা হয়েছে শুধু ভর্তুকি বাবদ।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারির আংশিক ভর্তুকি বাবদ ১ হাজার কোটি টাকা সম্প্রতি ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। বাকিটা চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে সমন্বয় করা হবে। তথ্যমতে, বিদ্যুতের লোকসান মেটাতে ২০১৪ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৬ বছরে সরকার মোট ভর্তুকি দিয়েছে ৪২ হাজার ৮৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
দেশে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা না থাকায় উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনেকগুলো বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে সরকারকে। গত ১০ বছরে সরকার ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। ভাড়ায় চালিত এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে তা ভর্তুকি দিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে গ্রাহকের কাছে। প্রতি বছর ভর্তুকির পরিমাণ দফায় দফায় বাড়ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছিল তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। নানা উৎস থেকে অর্থায়ন পেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলেও সেই বিদ্যুৎ কোথায় ব্যবহার হবে, তার চাহিদা তৈরি করতে পারেনি। এর বড় একটি কারণ হলো সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে না পারা। এর বাইরে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বলা হয়েছিল, সেটি যথাসময়ে না হওয়ায় এসব জায়গায় বিদ্যুতের যে চাহিদা তৈরি হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। ফলে উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে এ জটিলতা দেখা দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ