মৃত্যুদণ্ড হল আইনি পদ্ধতিতে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তিস্বরূপ হত্যা করা। যেসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে সাধারণত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে, সেগুলিকে বলা হয় ‘মৃত্যুদণ্ডার্হ অপরাধ’। অতীতে প্রায় সকল দেশেই মৃত্যুদণ্ড প্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন বিশ্বের ১৭০ দেশ মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে কিংবা এর চর্চা নীতিগতভাবে বা কার্যকর করা থেকে বন্ধ রেখেছে। এবার এ তালিকায় নতুন করে যোগ হতে যাচ্ছে আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন। মূলত, মানবাধিকার কর্মীদের সমালোচনার মুখেই এই শাস্তি বাতিল হতে যাচ্ছে।
আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনে মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন দেশটির আইনপ্রণেতারা। এই মহাদেশটির ২৩ তম দেশ হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বাতিলের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সিয়েরা লিওনের পার্লামেন্টের এ সিদ্ধান্তে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
দুই দশকের বেশি সময় আগে সর্বশেষ মৃত্যদণ্ড কার্যকরের পর পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনের পার্লামেন্টে সর্বোচ্চ এই দণ্ড বাতিলে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবারের এই ভোটাভুটিতে দেশটির পার্লামেন্টের বেশিরভাগ সদস্য মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিলের পক্ষে সর্বসম্মতভাবে ভোট দিয়েছেন।
সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস মাদা বায়ো শিগগিরই এই বিলে স্বাক্ষর করবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের পর বিলটি আইনে পরিণত হলে মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিলকারী আফ্রিকার ২৩তম দেশ হবে সিয়েরা লিওন। ওই বিলে সাজা ঘোষণার সময় বিচারকদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে ১৯৯৮ সাল থেকে স্থগিতাদেশ পালন করছে সিয়েরা লিওন। তখন থেকে মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্তরা অন্যান্য বন্দিদের থেকে আলাদা কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা ভিন্ন কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বন্দিজীবনকে ‘অমানবিক’ বলে সমালোচনা করছেন।
সিয়েরা লিওনে সর্বশেষ মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকর করা হয় ১৯৯৮ সালে। ১১ বছরের গৃহযুদ্ধের পর সেই সময় ফায়ারিং স্কোয়াডে দেশটির সেনাবাহিনীর অন্তত ২৩ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত থাকলেও রায় ঘোষণা থেমে থাকেনি।
সর্বোচ্চ সাজা বাতিলের বিল পার্লামেন্টে পাস হয়ে যাওয়ার পর রাজধানী ফ্রিটাউনের অ্যাডভোকেসি সংস্থা রিয়ানন ডেভিস অব অ্যাডভোকেইড বলেছে, আমরা ঠিক এটাই চেয়েছিলাম।
সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট, অ্যাটর্নি জেনারেল পার্লামেন্ট ও সুশীল সমাজকে ধন্যবাদ জানান দেশটির ইনস্টিটিউট ফর লিগ্যাল রিসার্চ অ্যান্ড এডভোকেসি ফর জাস্টিস (আইএলআরএজে)-এর প্রতিষ্ঠাতা বাসিতা মাইকেল। মূলত, মানবাধিকার কর্মীদের সমালোচনার মুখেই এই শাস্তি বাতিল হতে যাচ্ছে।
সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস মাদা বায়ো টুইটারে এ ব্যাপারে বলেন, আজ আমি দেশ থেকে স্থায়ীভাবে মৃত্যুদণ্ড আইন বিলুপ্ত করার সরকারের একটি প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছি। আমি দেশের নাগরিক, পার্লামেন্টের সদস্য, উন্নয়ন সহযোগী ও অধিকার কর্মীদের ধন্যবাদ জানাই— তারা আমাদের সঙ্গে অটলভাবে থেকে এ কাজে সাহায্য করেছেন।
এই নিষ্ঠুর সাজা বাতিলে সুশীল সমাজ বহু বছর ধরে লড়াই করে আসছেন। পশ্চিম আফ্রিকার ইংরেজিভাষী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সিয়েরা লিওনে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ হয়েছে।
দেশটির ইনস্টিটিউট ফর লিগ্যাল রিসার্চ অ্যান্ড এডভোকেসি ফর জাস্টিস (আইএলআরএজে) এর প্রতিষ্ঠাতা বাসিতা মাইকেল এ ব্যাপারে বলেন, আমাদের সামনের রাস্তা এখনও লম্বা ও কঠিন। তবুও একটি দেশ হিসেবে আমরা এখন গর্ব করতে পারি যে, আমাদের বইয়ে মৃত্যুদণ্ড নামের আর কিছু নেই। এই ঐতিহাসিক সাংবিধানিক বিজয়ে আমরা সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট, অ্যাটর্নি জেনারেল, পার্লামেন্ট ও সুশীল সমাজকে ধন্যবাদ জানাই।
মৃত্যুদণ্ডের বদলে সেখানে আজীবন কারাদণ্ড কিংবা সর্বোচ্চ ৩০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেওয়ার বিধান থাকবে। এছাড়া সাজা ঘোষণার ক্ষেত্রে বিচারকদের আরও সতর্কতা অবলম্বনের সুযোগ রাখা হয়েছে আইনটিতে।
অ্যাডভোকএইডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাবরিনা মাহতানি বলেন, এতে বিচারকেরা মামলার সব ধরনের পরিস্থিতি আমলে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। যেমন, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও মানসিক অসুস্থতার অতীত খুঁজে দেখা এবং আগে ঘটে যাওয়া অবিচার যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, তা প্রতিরোধেও আশার সঞ্চার হয়েছে।
তিনি বলেন, এই নিষ্ঠুর সাজা বাতিলে সুশীল সমাজ বহু বছর ধরে লড়াই করে আসছেন। পশ্চিম আফ্রিকার ইংরেজিভাষী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সিয়েরা লিওনে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড বাতিলের আইনটি নিয়ে শুক্রবার দেশটির পার্লামেন্টে প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়েছে। এ সময়ে ক্ষমতাসীন দল সিয়েরা লিওন পিপলস পার্টির পার্লামেন্টারি নেতা ম্যাথিও নিউমাহ সবাইকে মৃত্যুদণ্ড বাতিলের পক্ষে ভোট দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে ভালো কাজটি করতে আমরা কিছু ত্যাগ করতে যাচ্ছি, তা সবাইকে বুঝতে হবে।
ডেথ প্যানাল্টি প্রকল্পের কর্মকর্তা সাউল লেহারফ্রুয়েন্ড বলেন, সর্বোচ্চ শাস্তি বাতিলে সিয়েরা লিওনের ঐতিহাসিক পদক্ষেপে আমরা আনন্দিত। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার এই পদক্ষেপ অনুসরণ করবে বলে আমরা আশা প্রকাশ করছি।
আফ্রিকার যেসব দেশ মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিলের পক্ষে কাজ করছে সিয়েরা লিওন তাদের অন্যতম। গত এপ্রিলে মালায়ির সুপ্রিম কোর্ট সর্বোচ্চ সাজাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেন।
দেশটির সর্বশেষ তিনটি প্রশাসন এই মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিলেও গত বছরের জুন পর্যন্ত ডাকাতি, খুনসহ নানা ধরনের অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অন্তত ৯৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ