বিটিভি খুললেই ফসলের বাম্পার ফলনে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এদিকে উদ্বৃত্ত ৩০ লাখ টন, তারওপর ১০ লাখ টন আমদানিও করছে সরকার; তবুও বাড়ছে চালের দাম। কার ইশারায় বাড়ছে? সরকার দেখাচ্ছে মিলারদের, মিলাররা দেখাচ্ছে কৃষকদের, কৃষকরা আঙুল তুলছেন পাইকারদের দিকে, আবার পাইকাররা দায়ী করছেন আড়তদারদের। চালের দাম জড়িয়ে পড়েছে এক মহাচক্রে। যার মূল্য দিতে হচ্ছে মহামারিতে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষদেরকেই।
বাজারের সবচেয়ে কমদামি চালের কেজিই এখন ৪৮ টাকা। আগে যা ছিল বড়জোর ২৮-৩০ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা যায়, ৪৮ টাকা দামের চালটা বেশ লাল ও মোটা। এক বেলায় রান্না করা ভাত আরেক বেলায় খাওয়া যায় না। নাজিরশাইল বা মিনিকেটের দিকে হাত বাড়ালেই কেজিপ্রতি গুনতে হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭২ টাকা।
দেশে একমাসে চালের চাহিদা এখন প্রায় ২০ লাখ ২৮ হাজার টন। সেই হিসাবে বছরে চাহিদা প্রায় ২ কোটি ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টন। এদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতবছর ২০২০ এর ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের চাহিদা মিটিয়ে আরও ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ধান ও গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৯৫ কোটি ৫৩ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে ৩৭৬ কোটি ৩২ লাখ টন। সদ্যবিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের মে পর্যন্ত খাদ্য আমদানি হয়েছে ৬১ লাখ ৮২ টন। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৬০ লাখ ৪০ হাজার টন।
কার ইশারায় বাড়ছে চালের দাম? সরকার দেখাচ্ছে মিলারদের, মিলাররা দেখাচ্ছে কৃষকদের, কৃষকরা আঙুল তুলছেন পাইকারদের দিকে, আবার পাইকাররা দায়ী করছেন আড়তদারদের। চালের দাম জড়িয়ে পড়েছে এক মহাচক্রে। যার মূল্য দিতে হচ্ছে মহামারিতে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষদেরকেই।
এর মধ্যেই ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আবার ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরোর বাম্পার ফলনও হয়েছে। ধানের সংগ্রহও সন্তোষজনক। অর্থাৎ মহামারির মধ্যেও ধান-গমের সরবরাহ স্বাভাবিক। তবুও কমছে না চালের দাম, এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, মিলার ও ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত বাড়াচ্ছে চালের দাম। কোনওভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও বলছেন, মিলারদের কারসাজিতেই চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না।
মিলাররা বলছেন, বাম্পার ফলন হলেও সেই ধান এখনও কৃষকের গোলায়। বেশি দামের আশায় কৃষকরা মজুত করে রেখেছে।
স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন কৃষকরাও। তারা বললেন, ধান না বেচলে আমরা খাচ্ছি কী আর ধার-দেনা শোধ করছি কী দিয়ে? মিলারদের অভিযোগ ঠিক নয়। কৃষকরা কখনোই মজুত করে না। কৃষকের ঘরে সেই ব্যবস্থাও নেই। ধান উঠতে শুরু করলে একদিকে কাটা হয়, অন্যদিকে হাটে বিক্রি হয়। দাম বাড়ায় পাইকাররা।
জয়পুরহাটের মিলার লায়েক আলী জানিয়েছেন, ধানের উৎপাদন ভালো। কিন্তু সেই ধান কৃষকরা বিক্রি করছেন না। মিলাররা বাধ্য হয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বেশি দামে ধান কিনছে। এতে চালের দাম বাড়ছে।
বাদামতলীর পাইকার নিজাম উদ্দিন জানিয়েছেন, বাজারে চালের ঘাটতি নেই। তবু মিলাররা দাম বাড়াচ্ছেন। যে কারণে আমাদেরও বাড়াতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, মিলারদের কারসাজিতেই মূলত দামটা বাড়ছে। কিন্তু কোনোভাবেই বাজার অস্থিতিশীল করতে দেওয়া হবে না। তাই আমরা অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহ জোরদার করছি।
খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রান্তিক কৃষক অনেক আগেই ধান বিক্রি করেছেন। মিল মালিকরা বলছেন অতিরিক্ত লাভের আশায় কৃষক নয়, এমন অনেকেই ধান মজুত করেছে। কেউ যদি অবৈধ মজুত করে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২৫ শতাংশ করারোপ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শিগগিরই ১০ লাখ টন নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল আমদানি করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিলার ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে পড়ে সরকারকে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে নানামুখী কর্মসূচির আওতায় কর্মহীন পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা বাবদ চাল দিচ্ছে সরকার। করোনা যতদিন থাকবে এসব কর্মসূচিও ততদিন চলবে। এ কারণেই চালের নিজস্ব মজুত গড়তে চায় সরকার।
খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম গনমাধ্যমকে এ খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, ‘প্রাথমিকভাবে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহে ৫ লাখ টন ও ৫ লাখ টন আমদানি করে চালের নিজস্ব মজুত গড়া হবে। বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে খাদ্য মন্ত্রণালয় এর পরিমাণ বাড়াবে। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্বগ বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
মিলার ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে পড়ে সরকারকে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে নানামুখী কর্মসূচির আওতায় কর্মহীন পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা বাবদ চাল দিচ্ছে সরকার। করোনা যতদিন থাকবে এসব কর্মসূচিও ততদিন চলবে। এ কারণেই চালের নিজস্ব মজুত গড়তে চায় সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যারা কারসাজি করে চালের দাম বাড়াচ্ছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না দেখেই লাখ লাখ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। খাদ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিতেও কাজ হচ্ছে না। মহামারির মাঝেও অসাধু ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার কোটি টাকা। বাম্পার ফলন ও আমদানির মতো সরকারি প্রচেষ্টাগুলোর সুফল পাচ্ছেন না দরিদ্ররা।
এদিকে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্নআয়ের গরিব মানুষ। অথচ এই গরিবের মোটা চালের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে এক কেজি চাল কিনতে লাগে ৫০ টাকা। কোথাও কোথাও ৪৮ বা ৪৬ টাকাতেও মোটা চাল পাওয়া, তবে সেগুলো খুবই নিম্নমানের। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় বলছেন, মোটা চালের দাম এখন যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি। তারা আরও বলছেন, করোনায় কাজ হারানো মানুষেরা নতুন করে গরিব হওয়ার কারণে তারা মাঝারি বা চিকন চাল ছেড়ে মোটা চালের দিকে ঝুঁকছেন। এটাও দাম বাড়ার কারণ।
যদিও দেশে বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন বেশ ভালো হয়েছে। সরকারি গুদামে মজুত বেড়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দাম কমতির দিকে। কিন্তু তবুও দেশে বাজারের চিত্র তার উল্টো।
রাজধানীর শ্যামবাজার ও কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিকন বা মাঝারি ধরনের চালের উৎপাদন বাড়লেও মোটা চালের উৎপাদন সেই তুলনায় বাড়েনি। কিন্তু এই চালের চাহিদা বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। এছাড়া করোনায় কাজ হারানো একটি শ্রেণী নতুন করে গরিব হওয়ার কারণে তারা মাঝারি বা চিকন চাল ছেড়ে মোটা চালের দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে মাঝারি ও চিকন চালের চেয়ে মোটা চালের দাম তুলনামূলক ভাবে বেড়েছে বেশি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধে অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের আয় কমেছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, গত এক বছরে গরিবের মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশের মতো। সেখানে একই সময়ে চিকন ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ৯ শতাংশের মতো।
সরকারের এই সংস্থাটির তথ্য বলছে, গত এক মাসে গরিবের মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অথচ একই সময়ে চিকন ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ২ শতাংশেরও কম। তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই চালের দাম আগের সপ্তাহের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি।
সাধারণত, বোরো মৌসুম শেষে প্রতিবছর চালের দাম অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু এবার উল্টো দাম বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের ধারণা, চালের দাম সামনে আরও বাড়বে। রাজধানীর কাওরান বাজারের খুচরা তানভীর আহমেদ বলেন, ‘গত শুক্রবার মোটা চালের দাম ছিল ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজি। এখন সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। অর্থাৎ, মোটা চালের দাম গত এক সপ্তাহে দুই টাকার মতো বেড়েছে। শুক্রবার বিআর-২৮ চাল ৫৩-৫৪ টাকা এবং মোটা গুটি স্বর্ণা চাল মানভেদে ৪৮-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাদামতলী ও বাবু বাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ধানের দাম বেশি, এ কারণে চালের দাম বেশি।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মধ্যে বাংলাদেশেই এখন চালের দাম সর্বোচ্চ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এএফও) সর্বশেষ প্রতিবেদন এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সব দেশে চালের দাম কমেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘চালের দাম বাড়ার কোনও যৌক্তিকতা নেই। তবে ধানের দাম বাড়তি, তার প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। এছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধে অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের আয় কমেছে। তারা হয়তো বাধ্য হয়ে মোটা চাল কিনতে শুরু করেছেন। এর ফলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মোটা চালের দাম বেড়ে গেছে।’
রাজশাহী অঞ্চলের ধান-চালের চাতাল ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষক আগের মতো মোটা চাল উৎপাদন করে না। এখন অধিকাংশ কৃষক ইরি ২৯ চাল উৎপাদন করে। আর ইরি-১৪ ও ইরি-২৮ চাল মেশিনে ছেটে মিনিকেট ও নাজির শাইল হচ্ছে। ফলে বাজারে মোটা চালের সংকট আছে।’
এদিকে বাজারে শুধু মোটা চাল নয়, মাঝারি ও সরু চালের দামও কমেনি। ঢাকার খুচরা দোকানে মাঝারি বিআর-২৮ ও সমজাতীয় চাল মানভেদে ৫২ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশের মতো বেশি। আর সরু মিনিকেট চাল ৬০ থেকে ৬২ টাকা ও নাজিরশাইল চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ