ঈদ এলে সড়ক দুর্ঘটনাও যেনো শোক উদযাপনের মৌসুম হয়ে পড়ে। সারা বছর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও ঈদের সময় এর পরিমান অনেকাংশে বেড়ে যায়। ঈদ উপলক্ষে মানুষের বাড়ি ফেরা কাল হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবারই। সড়ক দুর্ঘটনার পরিমান বেড়ে এত বেগতিক দশা যে, দেশের দুই প্রান্তে দুটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে আজ একই দিনে। একটি ঘটে রংপুরে এবং অন্যটি যশোরে।
রংপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬ এবং আহত ১১ জন
আজ রোববার (১৮ জুলাই) রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বলদিপুকুর এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে সকাল পৌনে আটটার দিকে যাত্রীবাহী দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে স্পট ডেড হয়েছেন ৫ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি করার পর মারা গেছেন আর একজন। এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬ জন এবং আহত ১১ জন। আহতদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হতাহত ব্যক্তিদের নাম–পরিচয় এখন অব্দি জানা যায়নি।
মিঠাপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকতারুজ্জামান জানান, সেলফি পরিবহনের একটি বাস ঢাকা থেকে দিনাজপুরের দিকে যাচ্ছিল। আর জোয়ানা পরিবহনের একটি বাস রংপুর থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। বলদিপুকুর এলাকায় দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনার পর দুই বাসের চালক পালিয়ে গেছেন।
ওসি আকতারুজ্জামান আরও জানান, বাস দুটি মহাসড়কের একপাশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ রয়েছে। দুর্ঘটনার পরে যান চলাচল ব্যাহত হয়েছে। লাশ থানায় নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে তিনি জানান।
যশোরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ এবং আহত ৯ জন
এদিকে আজই আরেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে যশোরে। সেখানে ট্রাক, পিকআপ ও প্রাইভেটকারের ত্রিমুখী সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৯ জন। আজ রোববার (১৮ জুলাই) সকালে আরবপুর দিঘিরপাড় এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে।
যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, লজিস্টিক) শাহজাহান আহমেদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, নিহতরা হলেন— চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মেজেরহুদা গ্রামের মোংলা মণ্ডলের ছেলে আব্দুল আলিম (৩৫) এবং গোয়ালহুদা গ্রামের মোসলেম মোল্যার ছেলে জহুরুল ইসলাম (৫২)।
আহতদের মধ্যে দুইজন যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন বাড়ি ফিরে গেছেন। নিহত ও আহতদের স্বজনদের বরাত দিয়ে ওসি জানান, গরু কেনার জন্যে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থেকে ১২ জন ব্যাপারি একটি পিকআপে বরিশালের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে সকাল ৬টার দিকে যশোর শহরের আরবপুর দিঘিরপাড় এলাকায় পৌঁছুলে বিপরীতমুখী একটি ট্রাক পিকআপটিকে ধাক্কা দেয়। এরপর একটি প্রাইভেটকার ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দেয়। এতে দুইজন নিহত এবং ৯ জন আহত হয়েছেন। খবর পেয়ে যশোর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা ঘটনাস্থল থেকে আহতদের উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে।
যশোর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের লিডার শেখ মুজিবর রহমান জানান, খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিস। সেখানে একজনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এছাড়া আহত ৫ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডাক্তার এম আব্দুর রশিদ জানান, দুর্ঘটনার শিকার দুইজন হাসপাতালে আনার আগেই মারা যান। হাসপাতালে ভর্তি দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পরিসংখ্যান বলছে সরকারের পরিকল্পনার উল্টো কথা
সরকারের পরিকল্পনা ছিলো ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা নেমে আসবে অর্ধেকে। যদিও পরিসংখ্যান বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসেই (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) গত ১০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা। বাংলাদেশ পুলিশের দেয়া তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে তিন হাজারের বেশি সংখ্যক, যা এমনকি বার্ষিক হিসেবেও ২০০৯ সালের পর সর্বোচ্চ। অন্যদিকে এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ বছরে সর্বোচ্চে।
বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৯টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৬০ জন। আহত হয়েছেন আরো ৩ হাজার ২৯২ জন। এর আগে ২০০৯ সালে এর চেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছিল, ৩ হাজার ৩৮১টি। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় চলতি বছরের তুলনায় বেশি প্রাণহানি ঘটেছিল সর্বশেষ ২০০৮ সালে। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩ হাজার ৭৬৫ জন।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৫৮। পরের বছর তা নেমে আসে ২ হাজার ৬৪৬-এ। ২০১১ সালে তা আরো কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৪৬ জনে। এরপর ২০১২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৩৮। ২০১৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ৯৫৭ জন। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৭-তে। এর পর থেকেই ঊর্ধ্বমুখিতার ধারা বজায় রেখেছে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা। ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ২ হাজার ৩৭৬ জন। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা আরেকটু বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৬৩। এরপর ২০১৭ সালে ২ হাজার।
সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ পুলিশের দেয়া তথ্য ব্যবহার করে থাকে। যদিও বেসরকারি হিসাবে এসব দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। একইভাবে পরিবহন ব্যবস্থাপনাও ত্রুটিপূর্ণ। নিয়ন্ত্রক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা।
দেশের পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বলতার পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারকারীদের অসচেতনতাও দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ