গত কয়েক বছরে ইয়েমেনের বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল লুট হয়ে গেছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসী জোট এবং তাদের অনুগত স্থানীয় বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী মিলে জ্বালানি তেল লুট করেছে। প্রতিমাসে ইয়েমেন থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ ব্যারেল তেল নিয়ে যাচ্ছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। এমন অভিযোগ করেছে ইয়েমেনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত তেল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আম্মার আল-আজরায়ি।
গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেন থেকে তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে ইয়েমেন সরকার তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সময়মতো বেতন পরিশোধ করতে পরছে না। তেল বিক্রির অর্থ কোথায় খরচ করা হচ্ছে তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন আম্মার আল-আজরায়ি।
তিনি জানান, সম্প্রতি সৌদি-নেতৃত্বাধীন বাহিনী সৌদি আরবের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিযান বন্দরের কাছে ইয়েমেনের চারটি জাহাজ জব্দ করে। এগুলোর মধ্যে দু’টিতে ছিল পেট্রল, একটিতে কারখানায় ব্যবহৃত জ্বালানি তেল এবং অপরটিতে ছিল তরল গ্যাস।
গত ছয় বছর ধরে জল, স্থল ও আকাশপথে ইয়েমেনের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে সৌদি আরব। ইয়েমেনের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস হুদায়দা সমুদ্রবন্দরের ওপর অবরোধ আরোপ করে রাখার কারণে দারিদ্রপীড়িত দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরমে পৌঁছেছে। সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনী প্রায়ই ইয়েমেনের জন্য আমদানি করা তেলসহ অন্যান্য জরুরি পণ্য সামগ্রী জব্দ করে।
গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আম্মার আল-আজরায়ি আরও বলেন, সৌদি আরব কতৃক ইয়েমেনের তেল সম্পদ লুটের কারণে দেশটিতে দেখা দিয়েছে জ্বালানি সংকট। সম্প্রতি যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘ বলেছে, ইয়েমেনের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার ও দেশটির ওপর আগ্রাসন বন্ধ না হলে দেশটিতে দেখা দেবে ভয়াবহ মানবিক সংকট।
এর আগে ইয়েমেনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইয়েমেনে জ্বালানি সংকট এর চেয়েও খারাপ হলে বিপর্যয় দেখা দেবে। সৌদি হামলা ও অবরোধের কারণে ইয়েমেনে খাদ্যের পাশাপাশি জ্বালানি ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
ইয়েমেনে ২০১৪ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে। সেসময় ইরান সমর্থিত হুথিরা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজধানী সানা দখলে নিয়ে নেয়। ফলে দেশটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতপ্রাপ্ত সরকার ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়।
এর পরের বছর ইয়েমেন সরকারের সমর্থনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সামরিক জোট হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধে ইয়েমেনে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে তৈরি হয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুতর মানবিক সঙ্কট।
এ লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ইয়েমেনের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ, ঘরছাড়া হয়েছেন কয়েক লাখ। ধ্বংস হয়ে গেছে অসংখ্য ঘরবাড়ি ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো।
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে ইয়েমেনে। দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষেরই জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে তারা।
জাতিসংঘসহ একাধিক সংস্থা জানাচ্ছে, ইয়েমেনে প্রায় প্রতি মিনিটে অপুষ্টি ও কলেরা রোগের শিকার হয়ে একটি করে শিশু প্রাণ হারাচ্ছে। বাড়ি-ঘরহারা আশ্রয়হীন শরণার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে পঞ্চম লক্ষের কাছাকাছি। অবরোধের শিকার হয়ে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নিয়মিত খাদ্য ও জরুরি ওষুধ পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ত্রিশ লক্ষের বেশি ইয়েমেনি শিশু স্কুল ও পড়াশুনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে অব্যাহত সৌদি আগ্রাসনের কারণে।
কেন শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ?
আরব বসন্তের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন ইয়েমেনের ৩৩ বছরের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ। ২০১১ সালে তিনি তার ডেপুটি মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। দেশটির সবচেয়ে বড় শহর সানায় হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধে ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর স্বৈরশাসক আলি আবদুল্লাহ সালেহ মারা যান।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মানসুর হাদিকে চারপাশ থেকে নানা সংকট চেপে ধরে। জিহাদিদের হামলা, দক্ষিণে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন, সেনাবাহিনীতে সালেহর অনুগত বাহিনী, দুর্নীতি, বেকারত্ব, খাদ্যসংকট। সালেহর শাসনামলে ইয়েমেনের সংখ্যালঘু জাইদি শিয়া সম্প্রদায়ের হুথি বাহিনী কয়েক দশক ধরে একাধিকবার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, লড়াই করেছিল। নতুন প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে হুথি বাহিনী এবং উত্তরের সাদা প্রদেশসহ আশপাশের এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়। সরকারের ব্যর্থতায় বিরক্ত সাধারণ সুন্নিরা ২০১৪ সালের শেষে এবং ২০১৫ সালের শুরুতে হুথিদের প্রতি সমর্থন দেখায়। বিদ্রোহীরা ওই সময় সানাও দখলে নেয়।
সেনাবাহিনীর সালেহ অনুগত সেনারা হুথিদের সঙ্গে একজোট বেঁধে ক্ষমতা দখলে পুরো দেশ দখলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। চাপের মুখে মানসুর হাদি ২০১৫ সালের মার্চে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
হুথি বাহিনীর এই শক্তিশালী হওয়ার পেছনে ওই অঞ্চলের শিয়া শক্তি ইরান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলা হয়। ফলে পাল্টা হামলার জন্য জোটবদ্ধ হয় আরব বিশ্বের সুন্নি দেশগুলো। সৌদি আরবের নেতৃত্বে আটটি আরব দেশ (বেশির ভাগই সুন্নি) হাদি সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে শক্তি প্রয়োগ শুরু করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৩২
আপনার মতামত জানানঃ