বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বিভিন্ন দেশে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকির মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর প্রভাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। জলবায়ুর এহেন পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ এশিয়ার পোশাক উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর একটা বড় অংশ পানির নীচে তলিয়ে যাবে বলে এক গবেষণায় জানা গেছে। রয়টার্সের খবর
শুক্রবার প্রকাশিত ওই গবেষণায় জানা গেছে, পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত তাদের কারখানা উচ্চতর অবস্থানে স্থানান্তর না করলে এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠা যাবে না।
নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন গবেষক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ন্ত্রিত এই গবেষণার দায়িত্বে ছিলেন। তৈরী পোশাক খাতের জন্য গৃহীত অন্যান্য টেকসই উদ্যোগের তুলনায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি খুব কমই গুরুত্ব পাচ্ছে বলে গবেষণায় সতর্ক করা হয়।
গবেষণার লেখকবৃন্দ জেসন জুড এবং জে লোয়েল জ্যাকসন বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং একইসাথে ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা এশিয়ার বেশিরভাগ পোশাক শ্রমিককে সরাসরি প্রভাবিত করবে অথচ এ প্রসঙ্গে কেউ গুরুত্ব নিয়ে ভাবছেই না’।
তারা বলেন, ‘এখন যারা উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তাদের একটা বড় অংশ এই জলবায়ু সংকটের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে না’।
গবেষণায় আরও বলা হয়, বৃহত্তর এবং ট্রান্স-ন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল থেকে সরে এসে উচ্চতর লোকেশনে তাদের উৎপাদন ও সরবরাহ চালু রাখতে পারবে। কিন্তু সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র সরবরাহকারীরা। এক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশের উল্লেখ করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ এশিয়ার পোশাক উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর একটা বড় অংশ পানির নীচে তলিয়ে যাবে বলে এক গবেষণায় জানা গেছে।
বিশ্লেষণে জাকার্তা, নমপেন, তিরুপ্পুর, ঢাকা, গুয়াংজু, কলম্বো এবং হো চি মিন সিটির কারখানাগুলোর অবস্থান দেখিয়ে একটি মানচিত্র অঙ্কন করা হয়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত থিংক-ট্যাংক ক্লাইমেট সেন্টারের ডেটাতে কারখানার অবস্থানের এ মানচিত্র প্রদর্শিত হয়; মানচিত্রের শহরগুলোতে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছরে গড়ে একবার উচ্চতা উপকূলীয় বন্যার স্তরের নীচে নেমে আসবে।
ক্লাইমেট সেন্টারের ডেটা বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালে প্রকাশিত বৈশ্বিক ডেটাসেটের অনুমানের উপর ভিত্তি করে লেখা।
মানচিত্রে ফুটে উঠেছে যে, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি এবং চীনের গুয়াংজু শহরের ৫০-৬০% কারখানা এ দশকের শেষভাগে বার্ষিক উপকূলীয় বন্যা স্তরের নীচে অবস্থান করবে।
এশিয়ার উন্নয়নশীল বেশ কয়েকটি দেশের জন্যই তৈরি পোশাক একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন ও রফতানি খাত। এশিয়ার অগ্রসরমান অর্থনীতিগুলোর বেশির ভাগেরই ৫০ শতাংশের বেশি রফতানি আয় আসে এ খাত থেকে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী রূপ ধারণ করা নভেল করোনাভাইরাসের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে এশিয়ার রফতানিমুখী পোশাক খাত।
করোনা পরিস্থিতিতে এশিয়ার পোশাক উৎপাদকদের সামনে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুটি বিষয়। প্রথমত, এ অঞ্চলে উৎপাদিত তৈরি পোশাকের সিংহভাগ কাঁচামালই আসে চীন থেকে। আর নভেল করোনাভাইরাসের উৎপত্তি এ চীনে। দেশটিতে ভাইরাসটির সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে শুরু করলে প্রতিরোধের জন্য লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় সরকার। এতে চীনে একের পর এক বস্ত্র কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বস্ত্র রফতানিকারক দেশটি থেকে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল সরবরাহে এ অচলাবস্থার শুরু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
আর এখন যখন করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় চীনে কিছু বস্ত্র কারখানা উৎপাদনে ফিরেছে, তখন তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চাহিদা ইস্যু। এশিয়ার তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতা উন্নত দেশগুলোর রিটেইলাররা, বিশেষ করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। করোনা হানা দিয়েছে সেখানেও। ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর সেসব দেশের সরকার কঠোরভাবে লকডাউন পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। আর এতে বেশির ভাগ রিটেইলার তাদের দোকানগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
বিদেশী ক্রেতাদের ব্যবসা সংকোচনের প্রভাব পড়েছে এশিয়ার তৈরি পোশাক উৎপাদন খাতে। অনেক রিটেইলারই এখন তাদের কার্যাদেশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় থাকা পণ্যের কার্যাদেশ বাতিল করে দিচ্ছে তারা। এমনকি শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত এমন পণ্যও তারা আর নিতে চাইছে না। ফলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বিপাকে। তারা তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে।
এমন অবস্থায় গবেষণার এই ফল এশিয়ার পোশাক খাতকে আরও হুমকির মুখে ফেলে দিল। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সত্যিই হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠানই পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠেছে। তবু আমাদের কারখানাগুলোর পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তারা বলেন, কিন্তু রাতারাতি তো কারখানাগুলোকে কোন উচ্চতর জায়গায় সরিয়ে নেয়া সম্ভব না। মহামারিজনিত কারণে আমরা ইতিমধ্যে কঠিন একটা সময় পার করছি।
তারা বলেন, কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে ওঠার জন্য শ্রমিকদের তহবিল সরবরাহ— উভয় পদক্ষেপই গ্রহণ করতে হবে। আর তা করতে হবে দ্রুত ও বৈশ্বিক পর্যায়ে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৬
আপনার মতামত জানানঃ