বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ধর্ষণের জন্য নারীবাদীদের দায়ী করে বক্তব্য রেখেছেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু। ১৭ নভেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার সংসদে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল- ২০০০‘ পাস হয়। বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব তোলার সময় বাবলু আলোচনার জন্য দাঁড়ান। তিনি বলেন, “এখানে কী দেখছি মাননীয় স্পিকার, নারীবাদীরা নারী স্বাধীনতার কথা বলে নারীদেরকে উন্মুক্ত করে চলছে। যার কারণেই ধর্ষকেরা ধর্ষণের অনুভূতিকে এতটা একসেপ্ট করেছে যে ধর্ষণে উৎসাহিত হচ্ছে।”
পেশায় সাংবাদিক এমপি বাবলু বলেন, ‘আইনটি এখানে উত্থাপন করা হচ্ছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা কী দেখি মাননীয় স্পিকার, করি তো ধুলা দূর, রাজ্য ধুলায় ভরপুর। এত আইন করেছি, কিন্তু শুধুমাত্র সঠিক বাস্তবায়ন, প্রণয়ন ও প্রয়োগের কারণে আমাদের আইনগুলো ভেস্তে চলে যাচ্ছে।’ খবর সংসদ টেলিভিশন।
কিছুদিন আগে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ফেইসবুকে ছবি দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়া বাবলু বলেন, “এ আইনটা প্রয়োগের আগে আমাদের ধর্ষকেরা যাতে ধর্ষণের কাজে উদ্বুদ্ধ না হয়, তদের ভিতরে যেন ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত করে একটা মানবতা যেন ক্রিয়েট করে, তারা যেন মনুষ্যত্ব ফিরে পায়, এরকম একটা সিচুয়েশন যদি সমাজে থ্রো করা হয়, তাহলে এত কঠিন আইনের প্রয়োজন হবে না। একটা ফাঁসি কার্যকর করে একটা নাগরিক কমানোর প্রয়োজন হবে না। আমরা চাই ধর্ষক যেন না হয়। ধর্ষকের সংখ্যা যেন না বাড়ে।”
যৌন নিপীড়ন রোধে নারীদের পর্দার অন্তরালে রাখার যে কথা হেফাজেতে ইসলামের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফী বলেছিলেন, তাতেও সমর্থন জানিয়েছেন এই আইন প্রণেতা। বিতর্কিত ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর প্রয়াত নেতা আহমদ শফীর পথে সবাইকে চলার আহ্বান জানিয়ে বাবলু বলেন, “আমি যেটা বলবো, আমরা ইতিপূর্বে আল্লামা শফি সাহেবকে তেঁতুল হুজুর বলে উল্লেখ করেছি মাননীয় স্পিকার। আল্লামা তেঁতুল হুজুরের তেঁতুল থিওরিটাও যদি কাজে লাগানো যেত, তাহলে ধর্ষকেরা ধর্ষণ থেকে পিছপা হত। ধর্ষণ থেকে তারা নিরুৎসাহিত হত। তাদের ভিতরে ধর্মীয় অনূভূতি আসত।”
২০১৩ সালে এক ওয়াজ মাহফিলে নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে সমালোচনায় পড়েন হেফাজতের ইসলামের আমির আহমদ শফী। এবার জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একজন সাংসদ তার পক্ষে সওয়াল করলেন।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার আসন বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাহজাহানপুর) এ ধানের শীষের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেলে সেই ফাঁকে বিএনপির সমর্থন নিয়ে সংসদ সদস্য হয়ে যান স্বতন্ত্র প্রার্থী বাবলু। গত অক্টোবর মাসে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বাবলুর একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল ফেইসবুকে, সেটি তার বৈধ অস্ত্র বলে পরে জানান তিনি।
সংসদে দাঁড়িয়ে নারীবাদীদের জড়িয়ে মন্তব্য করলেও ধর্ষণবিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলনের মধ্যে নারীবাদী বলে কাদের বুঝিয়েছেন, তা স্পষ্ট করেননি বাবলু। বাংলাপিডিয়ায় নারীবাদকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে- “নারী ও পুরুষের মধ্যকার সমতার একটি মতবাদ, যাতে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য বিস্তার রোধে নারীদের সংগঠিত হওয়ার উপর এবং সামাজিক জীব হিসেবে সমঅধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের জন্য সমাজকে নিরাপদ আবাসস্থলে রূপান্তরিত করার উপর গুরুত্ব দেয়।”
উল্লেখ্য যে, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের চাপেই সরকার এ বিষয়ক আইনকে সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই আন্দোলনকে বিভিন্ন সময় সরকারপক্ষ ন্যায্য আন্দোলনের স্বীকৃতিও দিয়েছে। কিন্তু এবার সংসদে ওই আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এ ধরণের আলাপ হলেও সরকারি দলের এমপিরা তাতে বিশেষ কোনো বাধ সেধেছেন বলে জানা যায় না।
সামাজিক মাধ্যমে এমপির এমন মন্তব্য নিয়ে চলছে তুলোধুনী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল হাসান লিখেছেন, সাংসদ বাবলুর আলাপচারিতা জাতীয় সংসদের সদস্যদের মান, সরকারপক্ষের সাংসদদের মনোভাব এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দুর্বলতাকে প্রকটভাবে হাজির করেছে। সাংবিধানিকভাবে নারী অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু নারী নিপীড়ন থামানো যাচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় সংসদে যদি এহেন বক্তব্য আসে, সেটা নারীদের জন্য কঠিন সময়ের ইঙ্গিতই দেয়।
এসডাব্লিউ/আরা/১১২২
আপনার মতামত জানানঃ