সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। কখনও এটি সহজাত, তো কখনও বেছে নেয়া হয়। মাছিদের কথাই ধরা যাক। তাদের জীবনকালের প্রথম ৩০ মিনিট, তারা যেকোন অন্য মাছির সঙ্গে সঙ্গম করার চেষ্টা করে; পুরুষ বা নারী। কিছু সময় পরে, তারা কুমারী মাছিদের শরীরের গন্ধ চিনতে সক্ষম হয় এবং সেদিকেই মনোযোগ দেয়।
আবার ২০০৬ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, পুরুষদের থেকে নারীরা অনেক বেশি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও পদ্ধতিতে সঙ্গম করতে সক্ষম। এজন্য প্রাণীজগতে নারীরা অন্য নারীদের শুধুমাত্র যৌনতৃপ্তির জন্য প্রস্তাব জানায় এবং জননেন্দ্রিয়ের সংবেদনকে সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করে।
এই যেমন শীতকালীন প্রজননের ঋতুতে জাপানিজ ম্যাকাকাসসের নারীসঙ্গের জন্য তুমুল প্রতিযোগিতা করতে হয়। এই প্রতিযোগিতা শুধু পুরুষদের সাথে পুরুষদের নয়, নারীদের সাথে পুরুষদেরও। কারণ বেশ কিছু প্রাণীর নারীদের ক্ষেত্রে সমকামিতা শুধু প্রচলিতই নয়, নিয়মও। একজন নারী ম্যাকাকাস অন্য একজনের উপর চড়ে বসে; এরপর তার জননেন্দ্রিয় উদ্দীপিত করতে অন্য সেই নারীদের শরীরে ঘষতে থাকে। কখনও তারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে, কখনও জকি স্টাইলে একজন অন্যজনের উপর চড়াও হয়। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব লেথব্রিজের পল ভ্যাসেই ম্যাকাকাসের উপর ২০ বছর গবেষণা করে তার গবেষণাপত্রে এ’ কথা উল্লেখ করেন।
১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত সমকামিতা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা হয়নি কখনো। এর বড় কারণ সমকামিতাকে তখনও একটি ট্যাবু মনে করা হত। এখনও অনেকে মনে করে। একে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলা বা ধর্মীয় বিধান টেনে এর গ্রহণযোগ্যতাকে অস্বীকার করা এখনও খুব স্বাভাবিকভানে নেয়া হয়। যার দরুণ সমকামিতাকে মানুষদের সমাজ পশুর ন্যায় মূল্যায়ন করা হতো এবং এখনও কোথাও কোথাও এটা করা হয়।
তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বন্য প্রাণীর মধ্যে এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক। এই তথ্য পাওয়া গেছে আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে। বিশেষ করে সমকামি আচরণ খুজে পাওয়া যায় পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি; যেমন ডলফিন। এছাড়াও হাঁস, বানর, সিংহ, ভেড়ার মধ্যেও আছে সমকামিতা।
এর মধ্যে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, টেক্সাস, মেক্সিকো এবং নিউ মেক্সিকোর ‘হুইপটেল গিরগিটি’র নাম না নিলেই নয়। জানা যায়, এ প্রজাতির সব প্রাণিই নারী। তাদের পুরুষ শয্যাসঙ্গীর দরকার নেই। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে সেক্স-সদৃশ একধরনের ব্যাপার ঘটে। দেখা গেছে এক গিরগিটি আরেক গিরগিটিকে যদি জড়িয়ে ধরে রাখে তাহলে তাদের ডিমপাড়ার হার বেড়ে যায়। প্রকৃতির সমকামী প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! তাই জীববিজ্ঞানী জোয়ান রাফগার্ডেন এ গিরগিটিকে ‘লেসবিয়ান লিজার্ড’ হিসেবে তার ‘ইভল্যুশনস রেইনবো’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
যদিও একটি গোষ্ঠী সবসময়ই সমকামিতাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে দাবি করে থাকে। তবে সমকামিতার ব্যাপারটি নিখাদ বাস্তবতা। শুধু মানুষ নয়, প্রাণিজগতের ক্ষেত্রেও। জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিল তার ‘বায়োলজিকাল এক্সুবারেন্স: অ্যানিমেল হোমোসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি’ বইয়ে প্রায় পাঁচশ প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্বের উদাহরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা প্রাণিজগতে পনেরশ’রও বেশি প্রজাতিতে সমকামিতার সন্ধান পেয়েছেন। আর মেরুদণ্ডী প্রাণির তিনশ’রও বেশি প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্ব খুব ভালোভাবেই নথিবদ্ধ। সংখ্যাগুলো কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে।
এর মধ্যে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, টেক্সাস, মেক্সিকো এবং নিউ মেক্সিকোর ‘হুইপটেল গিরগিটি’র নাম না নিলেই নয়। জানা যায়, এ প্রজাতির সব প্রাণিই নারী। তাদের পুরুষ শয্যাসঙ্গীর দরকার নেই। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে সেক্স-সদৃশ একধরনের ব্যাপার ঘটে। দেখা গেছে এক গিরগিটি আরেক গিরগিটিকে যদি জড়িয়ে ধরে রাখে তাহলে তাদের ডিমপাড়ার হার বেড়ে যায়। প্রকৃতির সমকামী প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! তাই জীববিজ্ঞানী জোয়ান রাফগার্ডেন এ গিরগিটিকে ‘লেসবিয়ান লিজার্ড’ হিসেবে তার ‘ইভল্যুশনস রেইনবো’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
জীববিজ্ঞানী পিটার বকম্যান বলেন, “এমন কোনো প্রজাতির অস্তিত্ব নেই যেখানে সমকামিতা দেখা যায় না। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমী প্রজাতি ছাড়া যাদের মধ্যে আসলে সেক্স ব্যাপারটাই নেই; যেমন আরচিন (sea urchin) কিংবা এফিড (aphid)। অধিকন্তু, প্রাণিজগতের একটা অংশ আবার হার্মাফ্রোডিক; অর্থাৎ সত্যিকারের উভলৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, যাদের ক্ষেত্রে সমকামিতা ভিন্ন কোনো বিষয় নয়।”
এছাড়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের ‘আউট ইন ন্যাচার: হোমোসেক্সুয়াল বিহেভিয়ার ইন দ্য এনিমেল কিংডম’ নামের একটি ডকুমেন্টারিতে প্রাণিজগতের অসংখ্য সমকামিতার উদাহরণ তুলে ধরা হয়। ব্রুস ব্যাগমিল এবং জোয়ান রাফগার্ডেনের কাজের উপর ভিত্তি করে অসলোর ন্যাচারাল হিস্ট্রি যাদুঘরে ‘অ্যাগেইনস্ট নেচার?’ নামে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
প্রদর্শনীটি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে ২০০৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত চলে। এতে জীবজগতের সমকামিতা, উভকামিতাসহ প্রকৃতির নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় উদাহরণ হাজির করে ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনার ব্যবস্থা করা হয়। প্রদর্শনীটি বছরজুড়ে দেশ-বিদেশের অসংখ্য দর্শকের আগ্রহ ও মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়।
জীববিজ্ঞানী পিটার বকম্যান বলেন, “এমন কোনো প্রজাতির অস্তিত্ব নেই যেখানে সমকামিতা দেখা যায় না। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমী প্রজাতি ছাড়া যাদের মধ্যে আসলে সেক্স ব্যাপারটাই নেই; যেমন আরচিন (sea urchin) কিংবা এফিড (aphid)। অধিকন্তু, প্রাণিজগতের একটা অংশ আবার হার্মাফ্রোডিক; অর্থাৎ সত্যিকারের উভলৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, যাদের ক্ষেত্রে সমকামিতা ভিন্ন কোনো বিষয় নয়।”
ল্যারিএস গিস্ট নামের এক বিজ্ঞানী ক্যানাডিয়ান রকি পর্বতমালায় পাহাড়ি মেষদের মধ্যকার সমকামিতা পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়া জিরাফদের মধ্যে সমকামী প্রবণতা খুব প্রচলিত। এদের সমলিঙ্গের মধ্যে ভালোবাসার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ এমনকি গবেষকরা বলছেন, জিরাফদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই সমলিঙ্গের সঙ্গীর সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়৷ পাশাপাশি বোতলনাক ডলফিন প্রজাতিরও স্ত্রী ও পুরুষ দুই ধরনের ডলফিনের মধ্যেই সমকামিতা দেখা যায়৷ মুখ এবং নাক দিয়ে স্পর্শ করে সঙ্গীকে আদর করে তারা৷ পুরুষ ডলফিনরা সাধারণত উভকামী৷ এছাড়া পুরুষ বাইসনদের মধ্যে সমকামিতা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার৷ কেননা স্ত্রী বাইসনদের সঙ্গে বছরে একমাত্র একবার মিলন হয় তাদের৷ তাই প্রজনন মৌসুমে পুরুষ বাইসনরা একে অপরের সঙ্গে দিনে বহুবার মিলিত হয়৷
পিগমি শিম্পাঞ্জী বা বনোবোকে বলা হয় মানবজাতির সবচেয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ প্রাণী৷ তারা খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে মিলিত হতে থাকে। এমনকি সমলিঙ্গের সঙ্গেও তারা মিলিত হয়৷ গবেষণায় দেখা গেছে, নিজেদের আনন্দের জন্যই এটা করে তারা৷ তবে এটা ঠিক তারা এটাকে নিজেদের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করা এবং দুশ্চিন্তা দূর করার উপায় হিসেবেও মনে করে৷ স্ত্রীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি৷ মানুষের খুব কাছাকাছি বাস রাজহাঁসের। অনেক পাখিদের মতো রাজহাঁসরাও একগামী এবং বছরের পর বছর ধরে তারা এক সঙ্গীর সঙ্গে কাটিয়ে দেয়৷ এদের মধ্যে অনেকেই সঙ্গী হিসেবে সমলিঙ্গের হাঁসকে বেছে নেয়৷ গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ২০ ভাগ রাজহাঁস সমকামী। একটি পুরুষ ভেড়ার পালের ৮ ভাগ ভেড়াই সঙ্গী হিসেবে পুরুষদের পছন্দ করে, এমনকি প্রজননের সময়ও৷
অন্য প্রাণিতে যেমন সমকামিতার অস্তিত্ব আছে, মানুষের মধ্যেও তেমন। এটা স্বাভাবিক। কারণ মানবসমাজ প্রাণিজগতের বাইরের নয়। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিনসের প্রথমদিককার গবেষণার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দশ ব্যক্তির একজন সমকামী। কিনসের গবেষণা ছিল সেই চল্লিশের দশকে। যদিও আজও মানুষ সমকামিতাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। এখনও ভাবে প্রকৃতিবিরুদ্ধ। বৃহৎ এই প্রাণীজগতে মানুষ একটি অংশ মাত্র। তাই প্রকৃতির এই স্বাভাবিকতাকে মেনে না নিতে পারা, মানুষের ব্যর্থতা। যদিও বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশেও সমকামিতা আজ বৈধ। এরমধ্যে আছে তুরস্ক, মালি, জর্ডান, ইন্দোনেশিয়া, আলবেনিয়া, বাহারাইনসহ আরও কয়েকটি দেশ।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ