এবার প্রথমবারের মত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিত এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দ্রুত রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার পর এই প্রথম জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে কোনো প্রস্তাব গতকাল সোমবার (১২ জুলাই) বিনা ভোটে পাস হলো। একই সাথে জান্তাবিরোধী জোটে রোহিঙ্গাদের আমন্ত্রণের ঘটনায়ও বেশ নড়েচড়ে বসছে সংশ্লিষ্টরা।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘে প্রস্তাব গৃহীত
মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার হয়ে এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক বাস্তুচ্যুত হয়ে ২০১৭ সালের পর সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়৷ ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা তার আগে থেকেই বাংলাদেশে ছিল৷ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে পড়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেও তাদরর ফেরত নেওয়া শুরু করেনি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে ৪৭তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা বিষয়ক প্রস্তাবটি পাস হয়৷ বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সব রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুর মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি উপস্থাপিত হয়েছিল৷ আজ মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বাংলাদেশ মিশন জানায়, মিয়ানমারের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শুরু থেকেই প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয়ে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে প্রবল মতভেদ থাকায় শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো৷ প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়৷
প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধসহ সব প্রকার নির্যাতন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনা ও তদন্ত জোরদার করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়াকেও সমর্থন জানানো হয়৷
প্রস্তাবে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারকে মিয়ানমার বিষয়ক ‘নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধানী মিশন’-এর সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মানবাধিকার পরিষদ এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রতিবেদন উপস্থাপনের অনুরোধ জানানো হয়৷
অধিবেশনে জেনেভা মিশনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “মানবিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমানা উন্মুক্ত করে দেন৷ মিয়ানমারের অসহযোগিতা ও অনীহার কারণে এখনও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি৷”
রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও তাদের মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি জাতিসংঘে আলোচনায় সক্রিয় রাখা এবং রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান মোস্তাফিজুর রহমান৷
জান্তাবিরোধী জোটে রোহিঙ্গাদের আমন্ত্রণ
এদিকে মিয়ানমারে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে রোহিঙ্গাদের। ক্ষমতাসীন জান্তাবিরোধী জোটে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার শিকার রোহিঙ্গারা এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে চাইছেন।
দেশটিতে গত ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করলে তার প্রতিবাদে দেশজুড়ে এখনও বিক্ষোভ চলছে।
সু চির রাজনৈতিক দলের সদস্যরা ইতোমধ্যে একটি জান্তাবিরোধী জোট গঠন করেছে। ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ নামে এ জোট নির্বাসিত অবস্থায় আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার ও গণমাধ্যমের সহযোগিতা পেতে কাজ করে যাচ্ছে। গত মাসে জোটের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদেরকে জান্তাবিরোধী এ কার্যক্রমে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে তারা নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসও দেয়। এমনকি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়েও জোটের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়।
কিন্তু জান্তাবিরোধী জোটে যাওয়ার এ আমন্ত্রণকে রোহিঙ্গারা সতর্কতার সাথে দেখতে চাইছে। দেশের বাইরে বসে সমর্থন নেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিষয়টিকে ‘মাছ ধরার জন্য টোপ পাতার মতো’ বলে মনে করেন ওয়াই মার নামের এক রোহিঙ্গা।
২০১২ সালে রাখাইনে স্থানীয় বৌদ্ধদের সাথে সংঘর্ষের পর দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর সিত্তের নিকটবর্তী একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস করেন ওয়াই মার। তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে বলির পাঁঠা হয়ে থাকতে হয়।’
এদিকে এমন প্রস্তাবের পরও জান্তাবিরোধী এ জোটে কোনও রোহিঙ্গা সদস্য নেই। জোটটিতে বর্তমানে ৩২ জন সদস্য রয়েছেন।
জান্তাবিরোধী জোটের আমন্ত্রণে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিলবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও জাতিসংঘের অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে আশার আলো দেখতে পারছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৬২৭
আপনার মতামত জানানঃ