বিশ্বে গতবছর ক্ষুধা ও অপুষ্টি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, যার জন্য অনেকাংশেই দায়ী করোনাভাইরাস মহামারী। ক্ষুধা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আফ্রিকায় এবং অপুষ্টির শিকার মানুষের অর্ধেকেরও বেশি এশিয়ায়। সোমবার প্রকাশিত জাতিসংঘের তিন সংস্থার যৌথ এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। খবর রয়টার্স, এএফপির
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্মিলিতভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর থেকে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বিষয়ক প্রথম ব্যাপক আকারের মূল্যায়ন এটি।
যৌথ এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের এই সংস্থাগুলো বলেছে, “দুঃখজনকভাবে এই মহামারী খাদ্য পরিকল্পনাকে দূর্বল করে দিচ্ছে, যার কারণে হুমকির মুখে পড়ছে জীবন ও জীবিকা। বিশ্বের কোন অঞ্চলই এ হুমকি থেকে মুক্তি পায়নি।”
“বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির সার্বিক অবস্থা” শীর্ষক ২০২১ সংস্করণের এই প্রতিবেদনে ধারণা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বর্তমান ধারা চলতে থকলে জাতিসংঘের ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। প্রায় ৬৬ কোটি মানুষ ক্ষুধাপীড়িত থেকে যাবে। মহামারী না থাকলে যে সংখ্যা খানিকটা কম থাকত।
প্রতিবেদন বলছে, আগের পাঁচ বছর অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। কিন্তু গতবছর তা বেড়েছে প্রায় ৭৬ কোটি ৮০ লাখ, যা গোটা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। এছাড়া এ সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ১১ কোটি ৮০ লাখ বেশি। যৌথ উদ্যোগে করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ; শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ক্ষুধার্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যের অনিশ্চয়তাও তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে বিশ্বে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতি তিনজন মানুষের একজন এই অনিশ্চয়তার শিকার।’
‘ক্ষুধার্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যের অনিশ্চয়তাও তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে বিশ্বে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতি তিনজন মানুষের একজন এই অনিশ্চয়তার শিকার।’
বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ মহামারির আগে থেকেই মাঝারি বা গুরুতর খাদ্য সংকটে ছিল, গত দেড় বছরে তার কোনো উন্নতি হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। নতুন করে এই বিপুল পরিমাণ ক্ষুধার্ত মানুষ ২০২০ সালে যুক্ত হয়েছেন তাদের সঙ্গে।
তবে এই তীব্র খাদ্য সংকটের জন্য শুধু করোনা নয়, এর পাশাপাশি যুদ্ধ-সংঘাত, জলবায়ুগত পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও দায়ী করেছে জাতিসংঘ।
এ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘করোনা হচ্ছে সংকটের এই বিশাল হিমশৈলের চূড়া মাত্র। যুদ্ধ-সংঘাত, জলবায়ুগত পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতাও এই সংকটের জন্য দায়ী। তবে এটি সত্য যে, পুরো সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে করোনা মহামারি।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে ২০১০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অপরিবর্তনীয় হ্রাসের আশাকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে ক্ষুধা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে উদ্বেগজনকভাবে। ২০ সালের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ছাপিয়ে নিরঙ্কুশ এবং অনুপাতিক উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষুধা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯.৯ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা ২০১৯ সালের ৮.৪ শতাংশের চেয়ে বেশি ছিল।
অপুষ্টির শিকার অর্ধেকের বেশি ( ৪১ কোটি ৮ লাখ) এশিয়ায় এবং এক-তৃতীয়াংশের বেশি (২৮ কোটি ২০ লাখ) আফ্রিকায় বসবাস করে। এর মধ্যে ৬ কোটি লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে বসবাস করে। তবে ক্ষুধা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আফ্রিকায়, যেখানে মোট জনসংখ্যার ২১ ভাগই অপুষ্টির শিকার।
পরিমাপের অন্যান্য সূচকেও ২০২০ সালটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সামগ্রিকভাবে ২৩০ কোটিরও বেশি মানুষের (বিশ্বের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ) বছরজুড়ে পর্যাপ্ত খাবারের অভাব ছিল: মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রাদুর্ভাব হিসেবে পরিচিত এ সূচকের এক বছরের বৃদ্ধি গত পাঁচ বছরের সম্মিলিত বৃদ্ধির সমান ছিল। এছাড়া লিঙ্গ-বৈষম্য গভীরতর হয়েছে; ২০২০ সালে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা প্রতি ১০ জন পুরুষের বিপরীতে নারীর সংখ্যা ছিল ১১ জন, যা ২০১৯ সালের ১০.৬ থেকে বেশি।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২০ সালে অপুষ্টিতে সবচেয়ে বেশি শিশুরাই ক্ষতিগ্রস্ত। এই সময়ে ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৪ কোটি ৯০ লাখেরও বেশি শিশু ছিল খর্বকায়। খর্বাকৃতির (স্টার্টিং এর) প্রবণতা ২০১২- ১৩ সালের ৩৬ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে বাংলাদেশে এখনো পুষ্টির পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রয়েছে।
ডব্লিউএফপি-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসাইনের ধারণা, এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে ক্ষুধামুক্ত করতে অন্তত আরও এক যুগ সময় লেগে যেতে পারে।
বিশ্বের এই সংকটময় মুহূর্ত ২০৩০ সাল নাগাদ পরিবর্তন আনতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছে জাতিসংঘ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৮
আপনার মতামত জানানঃ