আট বছর কেটে গেলেও কিনারা হয়নি চাঞ্চল্যকর তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার। অভিযোগ রয়েছে, শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ তদন্তের কারণে ত্বকীর ঘাতকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দু’জন আসামির দুই ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পর এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, আট বছর পেরিয়ে গেলেও ত্বকী হত্যার বিচার এখনো শুরু হয়নি। এ দায় যতটা না বিচারব্যবস্থার, তার চেয়ে বেশি সরকারের। তদন্ত সংস্থা র্যাব বলছে, মামলাটি স্পর্শকাতর, তদন্ত চলছে। কবেনাগাদ শেষ হবে সেটা বলা কঠিন। স্থানীয়রা বলছেন, হত্যাকাণ্ড নিয়ে অতিমাত্রার রাজনীতিকরণ তদন্তকে থমকে দিয়েছে।
কী ঘটেছিল তখন?
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি ২০০৩ সালের নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচন ও ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষে কাজ করতেন। এছাড়া তিনি নারায়ণগঞ্জে বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে আন্দোলনসহ নাগরিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী তার দুই ছেলের মধ্যে বড়। ত্বকী চাষাঢ়ায় অবস্থিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র ছিল। ২০১৩ সালের ৭ মার্চ (নিখোঁজের একদিন পর ও লাশ উদ্ধারের একদিন আগে) এ লেবেল পরীক্ষার ঘোষিত ফলে পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছিল যা সারাদেশে সর্বোচ্চ। এছাড়া ও লেভেল পরীক্ষাতেও ত্বকী পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন পরীক্ষাতে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে ত্বকী শহরের শায়েস্তা খান সড়কের বাসা থেকে বেরিয়ে রাতেও বাসায় ফিরে আসেনি। পরে ৮ মার্চ সকালে শহরের চারারগোপে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ত্বকীর লাশ পাওয়া যায়। সে রাতেই নারায়ণগঞ্জ মডেল সদর মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় রাব্বি উল্লেখ করেন, আমার অতীত ও বর্তমান বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমার ভূমিকার কারণে কোনও কোনও মহল এ হতাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে বলে ধারণা করছি।
১০মার্চ ওই সময়ের নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি সারাহ বেগম কবরী ও রফিউর রাব্বি দুইজনই হত্যার জন্য বিশেষ মহলকে দায়ী করেন। ১৫মার্চ চাষাঢ়ায় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী ও রফিউর রাব্বি হত্যার জন্য সরাসরি শামীম ওসমানকে দোষারোপ করেন। পরদিন ১৬ মার্চ শামীম ওসমান এ ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ষড়যন্ত্র করে আইভী ও অন্যরা মিলে তাকে দোষারোপ করছে। ওইদিন রাতেই শামীম ওসমান বাদী হয়ে আইভীর বিরুদ্ধে জিডি করেন। ১৭ মার্চ রফিউর রাব্বিকে আহবায়ক করে ২০১ সদস্য বিশিষ্ট ‘সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ’ গঠন করা হয়।
১৮মার্চ রাতে রাব্বি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম ভূইয়া পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমান এর নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারের কাছে অবগতি পত্র দেয়। ২৪ মার্চ শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ত্বকী নিখোঁজ ও লাশ উদ্ধারের সময়ে তিনি ও তার ছেলে অয়ন দেশের বাইরে ছিলেন।
এদিকে অবগতি পত্রে থাকা শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি হন। ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাজীব দাস ভারতে অবস্থান করছেন। মিজানুর রহমান সুজন নারায়ণগঞ্জেই আছেন। সালেহ রহমান সীমান্ত হলো জাতীয় পার্টি হতে বহিষ্কৃত নেতা বজলুর রহমান রিপন ওরফে হাজী রিপনের ছেলে। সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমান ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হলেও রিফাত জামিনে ও সীমান্ত কারাগারে। অন্যদিকে জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া পারভেজের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল চাষাঢ়া শহীদ মিনারে ত্বকী মঞ্চের একটি অনুষ্ঠানে হামলা চালায় পারভেজ। ওই বছরের ৬ জুলাই বিকেল ৪টায় ঢাকার গুলশান থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন অস্ত্রধারী পারভেজকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ তার পরিবারের। এ ঘটনায় মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর ছোটভাই নারায়ণগঞ্জ নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ আলী রেজা উজ্জ্বলসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলায় তারা কারাভোগও করেন।
দুই আসামির স্বীকারোক্তি ও একজনের দেশত্যাগ
২০১৩ সালের ২৯ জুলাই র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ইউসুফ হোসেন লিটন প্রথম ত্বকী মামলায় আদালতে জবানবন্দিতে সরাসরি জড়িত বলে স্বীকার করেন। তিনি জবানবন্দিতে সালেহ রহমান সীমান্তের জামতলা ধোপাপট্টির বাড়িতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের স্থান কাল পাত্র সকল কিছুর বর্ণনা করে।
অন্যদিকে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার সুলতান শওকত ভ্রমর ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছিল, ত্বকী হত্যার নেতৃত্বে ছিলেন আজমেরী ওসমান। তবে ১৬ দিন পর অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর ভ্রমর তার জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেন। ২০১৪ সালের ২০ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েই নারায়ণগঞ্জ ও পরে দেশ থেকে পালিয়ে যান ভ্রমর।
সে এখনও দেশের বাইরে। এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুল ইসলামের আদালত ভ্রমরের জামিন বাতিল করে তার বিরুদ্ধ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এদিকে র্যাব যেসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনেছিলেন তাদের সবাই পলাতক। রাজীব, কালাম সিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন ও আজমেরীর গাড়িচালক জামশেদ।
তদন্তে ধোঁয়াশা
তদন্তে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে ত্বকীর লাশের সঙ্গে থাকা স্যান্ডেল ও প্যান্টের পকেটে থাকা ত্বকীর ব্যবহৃত মোবাইল (ওয়ালটন ব্রান্ডের) সেট। গ্রেপ্তার দুই আসামি আদালতে বলেছেন, ত্বকীর লাশ যেখানে পাওয়া যায় সেখান থেকে কমপক্ষে ২ কিলোমিটার দূরে তাকে নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে নদীতে ফেলা হয়। কিন্তু লাশের সঙ্গে কোনো বস্তা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ত্বকীর স্যান্ডেল পাওয়া যায় তার দু’পায়েই।
প্রশ্ন হচ্ছে নির্যাতনের পর লাশ বস্তায় ভরে পানিতে ফেলার পর স্যান্ডেল থাকা সম্ভব কিনা। আরও অনেক প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আজমেরী ওসমানের অফিস থেকে র্যাব রক্তমাখা একটি প্যান্টও উদ্ধার করে এবং ওই প্যান্ট ত্বকীর ছিল এমন একটি ধারণা দেয়া হয়।
কিন্তু পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাশ উদ্ধারের সময়ই ত্বকীর পরনে জিন্স প্যান্ট ও শার্ট ছিল। তাছাড়া আসামি ভ্রমরের জবানবন্দি বারবার আমলে নিলেও বাদীপক্ষ অপর আসামির জবানবন্দি কেন আমলে নিচ্ছেন না, সেটিও তদন্তে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান বলেন, সরকার প্রভাবশালী এ পরিবারকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ জানান, এ ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে চারজনই জামিনে মুক্ত।
দায় যতটা না বিচারব্যবস্থার, তার চেয়ে বেশি সরকারের
নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ৯৯ মাস উপলক্ষে গত জুনে ঘাতকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করেছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট। অনুষ্ঠানে রফিউর রাব্বি বলেন, আট বছর পেরিয়ে গেলেও ত্বকী হত্যার বিচার এখনো শুরু হয়নি। এ দায় যতটা না বিচারব্যবস্থার, তার চেয়ে বেশি সরকারের। কারণ, তদন্তে যখন ত্বকীর ঘাতক সরকারদলীয় চিহ্নিত হলো, তখনি সরকার এ বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
দলীয় সন্ত্রাসীদের রক্ষার জন্য সরকার ত্বকী হত্যায় অঘোষিত ইনডেমনিটি জারি করে রেখেছে। দেশে সুশাসন, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র— সবকিছুই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সবকিছু দলীয়করণ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকে ধ্বংস করেছে সরকার। বিচারপ্রক্রিয়া ও আইনের স্বাভাবিক গতিকে ধ্বংস করেছে।
সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্যসচিব হালিম আজাদ বলেন, ‘একজন গডফাদার তার ভাতিজাকে নিয়ে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। গডফাদারকে রক্ষার জন্যই ত্বকী হত্যার বিচার বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে এ হত্যার বিচার শুরু করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ