করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে, সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে।
সবচেয়ে সংকটে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ। লকডাউনের কারণে কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে। এতে অনেকের আয় কমেছে; অনেকে কাজ হারিয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেও মানুষের চিকিৎসা ও পরিবহণসহ বিভিন্ন ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলেছে।
শহরাঞ্চলের সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো বাসাভাড়া। এছাড়া পাঁচটি মৌলিক চাহিদার চারটি নিয়েও চিন্তিত তারা। এ অবস্থায় জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। মোট কথা, এখন মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের চরম দুর্দিন চলছে। লকডাউনের কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও খাবার ও বাসাভাড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
এদিকে সরকারের জারি করা কঠোর বিধিনিষেধের ষষ্ঠ দিনে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে সীমিত সংখ্যক যানবাহন চলাচল করেছে। সড়কে রিকশা ছাড়া অন্য যানবাহনের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমেছেন কাজের খোঁজে। বিশেষভাবে ছিন্নমূল ও যারা দিনে এনে দিনে খান তাদের এই কাতারে দেখা গেছে। রাজধানীর বিশেষ মোড়ে মোড়ে তাদের অবস্থান। মিরপুর, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব মানুষের জটলা দেখা যায় মঙ্গলবার সকাল থেকেই।
মঙ্গলবার (৬ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার, রাসেল স্কয়ার, কল্যাণপুর ও গাবতলীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অলিগলিতে মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে। তাদের কেউ বের হয়েছেন বাজার করতে, কেউ কর্মস্থলে যোগ দিতে, কেউ সকালের নাস্তা করতে। আবার কেউবা বের হয়েছেন শারীরিক কসরত করতে। গলির কিছু কিছু দোকানের শাটার অর্ধেক খোলা রেখে বিক্রি চলছে। ছোট কয়েকটি হোটেলে বসে খাওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। মহল্লার সাধারণ বাজারের পাশাপাশি ভ্যানে বিক্রি করার জন্য সবজির বিক্রেতাদের প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে।
মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের সামনে খেটে খাওয়া অনেক মানুষকে কাজের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, মানুষের কাছে হাত পাততে পারি না। কাজ করেই খাই। লকডাউনের জন্য কাজে যোগ দিতে পারছি না। টাকা না থাকায় বাসায় বউ ছেলে-মেয়েদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারছি না। তাই কাজের সন্ধানে এখানে এসেছি। যদি কারও প্রয়োজন হয়, তবে এখান থেকেই তারা আমাদের নিয়ে যায়।
এদিকে লকডাউনে কর্মহীন নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি)। সংস্থা দুটির ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই বরাদ্দের কথা জানেই না নিম্নআয়ের মানুষেরা। করপোরেশন সংশ্লিষ্টদের কাছে সাহায্য চেয়ে ফিরে আসার অভিযোগও করেছেন অনেকে।
ডিএসসিসি সূত্র জানিয়েছে, সংস্থাটি তার পুরানো ৭৫টি ওয়ার্ড ও ১০টি অঞ্চলের জন্য ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় এই অর্থ থেকে খাদ্য সহায়তা পাবেন নিম্নআয়ের মানুষ। তবে এজন্য নির্বাহী কর্মকর্তা বা কাউন্সিলরের কাছে খাদ্য সহায়তা চেয়ে মানুষকে যেতে হবে। তবে কাউন্সিলরা জানিয়েছেন, তারা এখনও এই ৫০ লাখ টাকার বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাদের কাছে সেই টাকা এখনও পৌঁছেনি।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির ২৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হাসিবুর রহমান মানিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, লকডাউনের আগে আমাদের কাছে ৪২ শিশুর জন্য শিশু খাদ্য এসেছে। সেখানে ৯ ধরনের খাবার ছিল। আমরা সেগুলো বিতরণ করেছি। এছাড়া আমার ব্যক্তিগত অর্থ থেকে এলাকায় খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে যাচ্ছি। এই লকডাউনে এখনও করপোরেশন থেকে কোনও অর্থ পাইনি। তবে এখনও মানুষের ঘরে খাদ্য রয়েছে। একজন রিকশাচালকের ঘরেও ৭-১০ দিনের খাদ্য মজুত থাকে। আর আমরা চাই মানুষ লকডাউন পালন করুক। তাহলে করপোরেশনের পক্ষ থেকে তাদের ঘরে আমরা খাদ্য পৌঁছে দিবো।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যাদের খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন তাদের জন্য আমাদের ৭৫টি ওয়ার্ড বা ১০টি অঞ্চলের বিপরীতে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। কারও সহায়তার প্রয়োজন হলে আমাদের কাউন্সিলরদের মাধ্যমে বা সরাসরি আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে সহায়তা চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে তারা এই বরাদ্দ থেকে সহায়তা দেবেন। এছাড়া আমরা আড়াই লাখ মাস্ক, আড়াই লাখ হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও আড়াই লাখ সাবান বরাদ্দ দিয়েছি। প্রয়োজন হলে আরও বরাদ্দ দেওয়া হবে।
একইভাবে উত্তর সিটি করপোরেশনও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। সংস্থাটির মেয়র আতিকুল ইসলাম তার ব্যক্তিগত প্লাটফর্ম ‘সবাই মিলে সবার ঢাকা’র পক্ষ থেকে অসহায় ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এরই মধ্যে তার সংস্থা প্রতিটি কাউন্সিলরের জন্য ৬৪ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছেন। এই অর্থ দিয়ে তারা শিশু খাদ্যসহ নিম্নআয়ের মানুষকে সহায়তা দেবেন। এছাড়া ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ লাখ টাকা ও এক হাজার মেট্রিক টন চল বরাদ্দ এসেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এগুলো বিতরণ শুরু হবে।
তিনি আরও বলেন, আসলে গত বছর যখন লকডাউন ছিল তখন কোনও কিছুই চলতো না। মানুষের কাজ করার সুযোগ ছিল না। এখন অনেকেই কিছু কাজকর্ম করার সুযোগ পাচ্ছে। সে কারণে আগের মতো খাদ্য সহায়তা চাওয়ার মানুষ তেমন এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও আমরা প্রস্তুত। কেউ সহায়তা চাইলে আমরা পৌঁছে দিচ্ছি।
এদিকে সকালে খিলগাঁও রেলগেট ও শাজাহানপুর এলাকায় নিম্নআয়ের বহু মানুষকে হাত পাততে দেখা গেছে। তারা সবাই রেলওয়ে বস্তিতে থাকেন। তাদের একজন শাহানারা বেগম। জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, যানজটের মধ্যে রাস্তায় গামছা, খেলনাসহ নানা জিনিসপত্র বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন কোনও যানবাহন নেই। রাস্তায় মানুষও নেই। তাই বেচা-বিক্রি নেই। বাসায় খাবার নেই। কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে জানানো হয়েছে, কোনও বরাদ্দ আসেনি। তাই রাস্তায় হাত পাততে নেমেছি।
সিরাজুল ইসলাম নামে এক ভিক্ষুক বলেন, প্রতিদিন ভিক্ষা করে যা আয় হতো তা দিয়েই ৫ সদস্যের পরিবার চলতো। এখন ভিক্ষাও পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটে মানুষ নেই।সিটি করপোরেশনের অফিসে গিয়েছি কয়েকবার, কোনও সহায়তা পাইনি। লকডাউন বাড়ানো হলে যদি খাদ্য সহায়তা না দেওয়া হয় তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার এক বছরে দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। বস্তুত করোনার কারণে গত বছরের মার্চ থেকেই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। গত সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও পুরো গতি পাওয়ার আগেই হানা দেয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। গত বছর ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে।
তারা বলেন, করোনা বিশ্ব অর্থনীতিকেই লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতি কী করে স্বাভাবিক করে তোলা যায়, তা নিয়ে সবাই ভাবছে। যেহেতু এ সংকট কাটিয়ে ওঠার সহজ কোনো উপায় নেই; সেহেতু সংকট মোকাবিলায় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে এবং সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। সীমিত আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতির গতি ফেরাতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নিতে হবে বিশেষ পদক্ষেপ। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সবাইকে হতে হবে দায়িত্বশীল ও সহমর্মী।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ