বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে উত্তর মেরুর অর্থাৎ আর্কটিক সাগরের বরফ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং এই প্রাকৃতিক তাপস্থাপকে কোন সমস্যা পরিবেশবিদদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর উষ্ণতা নিয়ামক নামে পরিচিত। তার কারণ এই দুই অংশে বরফের স্তর। অথচ সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী ২০৫০ সালে উত্তর মেরু অঞ্চলে সম্ভবত কোনো বরফই দেখা যাবে না৷
যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস এজেন্সি (নাসা)’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮১ থেকে ২০১০ অব্দির গড় হিসাবে প্রতি দশকে আর্কটিকের বরফের পরিমাণ ১৩.১ শতাংশ কমে যায়।
এদিকে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা কমিউনিকেশন্স আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গ্রিনল্যান্ডের উত্তর থেকে শুরু করে কানাডার দিকে আর্কটিক সাগরের দ্বীপপুঞ্জগুলি পর্যন্ত বিস্তৃত ‘লাস্ট আইস এরিয়া’ নামে পরিচিত অঞ্চলটির বরফও এবার গলতে শুরু করেছে।
এর আগে গ্রীষ্মকালেও আর্কটিক সাগরের এই বরফ গলত না। এতটাই জমাট বাঁধা ছিল। তাই গ্রীষ্মে যখন বরফ গলতে শুরু করতো, তখন আর্কটিক সাগরে মেরুভল্লুকদের শেষ ঠিকানা ছিল ‘লাস্ট আইস এরিয়া’।
গত বছরের আগস্টে বিভিন্ন ভূপর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইটের পাঠানো তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেন, ইতিপূর্বে আর্কটিক সাগরের যে অঞ্চলগুলোতে সারা বছর বরফ জমে থাকতো, সেই একাংশ ওয়ান্ডেল সাগরের বরফে ভয়ঙ্কর ভাবে চিড় ধরেছে। স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পড়েছে গ্রিনল্যান্ড আর কানাডার উত্তর উপকূলেও সমুদ্রের বরফের ঘনত্ব ৫০ শতাংশ কমে যায় গত অগস্টে। যা গ্রীষ্মে আর্কটিক সাগরে বরফের ঘনত্ব কমে যাওয়ার সর্বকালীন রেকর্ড।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (আইপিসিসি)’র ২০০৭ সালে প্রকাশিত চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ক্রমাগত পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে চলেছে গ্রিন-হাউস গ্যাসগুলো। এর ফলে প্রকৃতির ওপর পড়ছে নানা ধরনের বিরূপ প্রভাব। এমনকি এই অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার প্রধান কারণও এটি।
উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন পতিস্থিতিতে বরফের পরিমাণ কমে যাওয়া বিশ্বের সামগ্রিক তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর্কটিক সাগরের বরফ আনুমানিক ৮০ শতাংশ সূর্যের আলো মহাকাশে ফেরত পাঠায়। যার অর্থ এই বিশাল অঞ্চল পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কোনও ভূমিকা রাখে না। এই অঞ্চল এত বিশাল এলাকা জুড়ে, যে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এর নিষ্ক্রিয়তা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু যখন এই সমুদ্রের বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রের পানি বেরিয়ে আসছে; যা কিনা প্রায় ৯০ শতাংশ সূর্যের তাপ শোষণ করে নেয়। এর ফলে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা ব্যাপকহারে বেড়ে যাচ্ছে। একে বলা হয় ‘আলবেডো ইফেক্ট’। কারণ হালকা পৃষ্ঠতল গাঢ় পৃষ্ঠতলের থেকে বেশি তাপ বিকিরণ করে।
আর্কটিক সাগরের বরফ জমাট বাঁধা এবং গলা মৌসুমি ঘটনা। মার্চে বরফ জমাট বাঁধতে শুরু করে এবং সেপ্টেম্বরে বরফ গলা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়।
যাইহোক, সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে এবং স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি থেকে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, বরফ জমা ও গলার এই মৌসুমি চক্র অনেকটাই ব্যহত হয়েছে। কারণ বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ দৃশ্যতভাবে আর্কটিকের অক্ষবর্তী অঞ্চলের সমুদ্রে বরফের ব্যাপ্তি কমে যাচ্ছে।
এর ফলে তাপ বিকিরণ কমে গেছে কারণ সমুদ্রের কালো পৃষ্ঠতল অনেক বেশি তাপ শোষণ করে। এর ফলে সমুদ্র ও ভূমির উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে।
এখানে বিজ্ঞানীরা শঙ্কিত এই ভেবে, যে হারে ভূমি বরফের আবরণ থেকে বেরিয়ে আসছে, তা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ট্রিগারটা এমনভাবে চেপে ধরতে পারে, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
গত বছরের শেষের দিকের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ৪০ থেকে ১০০ বছর সময়কালে গ্রিনল্যান্ডের বরফের আস্তরণে তাপমাত্রা বের কয়েকবার ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে।
লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক রবি ম্যালেট তার সহকর্মীদের নিয়ে স্যাটেলাইট ডেটা এবং নতুন কম্পিউটার মডিউলেশনের সাহায্যে নতুন একটি গবেষণায় চালান। এই গবেষণায় উঠে এসেছে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। উত্তর মেরুর আর্কটিক মহাসাগরের বরফ গলার যে হার বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছিলেন, বাস্তব হার তার প্রায় দ্বিগুণ।
এমনকি, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে আর্কটিকের কিছু অংশে বরফের কোনো আস্তরণ থাকবেই না।
গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর মেরুর খুব সামান্য অংশ বাদ দিলে কোথাও আর বরফের ওপর তুষারের স্তর জমা হয় না। আর কঠিন বরফের স্তরও ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে। অনেক জায়গায় উন্মুক্ত হয়ে গেছে সমুদ্রপৃষ্ঠ।
এখনই তার সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান প্রকাশ না পেলেও ম্যালেট জানিয়েছেন, আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলার হার আগের ধারণার চেয়ে ৭০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ দ্রুত হচ্ছে।
এমনটি ঘটলে কেবল বৈশ্বিক তাপমাত্রাই বাড়বে না, বরং এর পাশাপাশি বিশ্বের বহু উপকূলীয় অঞ্চলে চরম আবহাওয়া এবং বন্যার ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ