
সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন শত শত নারী সিরিয়ার আল-হোল বন্দিশিবিরে আটক রয়েছেন। এদের অনেকেই অনলাইনে যোগাযোগ হওয়া বিদেশি অবস্থাপন্ন পুরুষদের বিয়ে করছেন। নতুন স্বামীদের পাঠানো অর্থের বিনিময়ে বন্দি শিবির থেকে ইতোমধ্যে পালিয়েছেন কয়েকশ নারী। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এক বিশেষ প্রতিবেদনে শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে।
গার্ডিয়ান জানায়, শরণার্থী শিবিরগুলোতে আছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। একইসঙ্গে, অবস্থানরত নারীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বহু দেশ। আটকে পড়া এসব নারীদের জন্য বিয়ে করে শিবির ছেড়ে যাওয়াই এখন সবথেকে সহজ পথ। নারীদের মধ্যে তাই অনলাইনে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে অবস্থাপন্ন পুরুষদের বিয়ে করার চর্চা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
হোল শিবিরের ভেতরে ও বাইরে থাকা ৫০ জন নারী, এক কুর্দি কর্মকর্তা ও আইএসের সাবেক এক সদস্য জানিয়েছেন, মুক্তির জন্য বন্দিশিবিরের বাসিন্দারা চক্রটির কাছে সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন।
বন্দিশিবিরে থাকা এক রুশ নারী বলেন, ‘প্রতিদিন আমি এক পুরুষ আমার কাছে বার্তা পাঠায়, আমি বিয়ে করতে চাই কিনা। আমার আশেপাশের সবার বিয়ে হয়ে গেছে…অবশ্য যারা এখনও আইএসের সমর্থক এবং সচ্চরিত্রের দাবি করেন, তারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।’
বন্দিশিবিরের নারীরা এই বিয়ের মাধ্যমে তাদের নিরাপদ আয় নিশ্চিত করতে চাইছে এবং জীবনকে কিছু স্বাচ্ছ্যন্দময় করতে চায়। বিদেশি স্বামীদের পাঠানো অর্থ এসব নারী খাদ্য, ওষুধ, ফোনের বিল ও গৃহকর্মীদের জন্য ব্যয় করছে।
ফেসবুকের মাধ্যমে বন্দিশিবিরের নারীদের বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়। এর জন্য আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল ফেসবুক পেজগুলো ব্যবহার করা হয়।
স্ত্রী প্রত্যাশী এমনই এক ব্যক্তি আরবিতে লিখেছেন, ‘আমার একটি অনুরোধ আছে… ধর্ম মেনে চলতে চান এমন একজন স্ত্রী কি আমি শিবির থেকে খুঁজে পেতে পারি? আমি তাকে যে কোনো মূল্যে শিবির থেকে বের করে আনতে পারব।’
এভাবে বিয়ের পর হোল বন্দিশিবির থেকে কতজন নারী পালিয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে একটি চিত্রে শিবিরের মানুষ কমার বিষয়টি বোঝা গেছে। দুই বছর আগে বন্দিশিবিরের তাবুগুলোতে জায়গা ও অন্যান্য জিনিসপত্রের জন্য মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। এখন অনেক তাবু ফাঁকা।
যেভাবে বিয়ে হয়
ফোনের মাধ্যমে এই বিয়েগুলো পড়ানো হয়ে থাকে। সাধারণত নারীদের ফোনে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। কোনো কাজীর মধ্যস্থতায় বিয়ে পড়ানোর পর বরকে পাত্রীর নতুন ওয়ালি বা অভিভাবক ঘোষণা করা হয়। নতুন কনে এসময় যৌতুক হিসেবে নগদ অর্থ বা নতুন মোবাইল ফোন উপহার পান।
ভার্চুয়াল এই সম্পর্কগুলো শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতায় সীমাবদ্ধ নয়। দ্য গার্ডিয়ানের হাতে আসা বহু ইঙ্গিতপূর্ণ ম্যাসেজ এবং ছবি থেকে দেখা গেছে যে সম্পর্কগুলো অনেকক্ষেত্রেই প্রেম কিংবা যৌনতাপূর্ণ।
গতমাসে ইদলিব প্রদেশের একজন যোদ্ধা নিহত হওয়ার পর তার ফোন থেকে আল-হোলে অবস্থানরত একাধিক নারীর সাথে যৌনতাপূর্ণ ম্যাসেজ ও ছবি চালাচালির প্রমাণ পাওয়া যায়।
নারীদের অনেকের প্রকৃত স্বামী এখনো জীবিত অবস্থায় এসডিএফের হাতে আটক আছেন। তবে, এই নারীদের দাবি, তাদের নতুন করে বিয়ে করার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে, কেননা তারা জানেন না যে তাদের স্বামী এখনো মুসলিম আছেন কিনা।
নতুন স্বামী প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হলে অনেকে নতুন করে পুনরায় বিয়েতে বসবেন বলেও মন্তব্য করেছেন।
যেভাবে পালিয়ে যান
প্রতিটি বিয়ের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। প্রথমে শিবিরের নারীরা ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে সিংহ বা অন্য কোনো আইসিস সম্পর্কিত প্রতীকী ছবি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে, মুসলিম উম্মাহকে আহ্বান জানানো হয় তাদের উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসতে।
তবে, আইসিসের কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে তারা ফেসবুক বা ইন্সটার বদলে টেলিগ্রাম বেছে নেন। এনক্রিপ্টেড পদ্ধতি থাকায় এখান থেকে জঙ্গি কার্যক্রমের আলোচনা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
নির্বাচিত স্বামীরা প্রথমে সরাসরি তুরস্কে তারযোগে অর্থ পাঠান। চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে পশ্চিমা দেশ থেকে প্রথমে দ্বিতীয় কোনো দেশে অর্থ পাঠানো হয়। সেখান থেকে অর্থ তুরস্কে যায়, এরপর নগদ আকারে সীমান্ত পার করে অথবা হাওয়ালার মাধ্যমে সরাসরি সিরিয়ায় তারযোগে অর্থ পাঠানো হয়।
শিবিরের নিরাপত্তাকর্মীদের ঘুষ প্রদান এবং জাল পাসপোর্টের মাধ্যমে সিরিয়া থেকে পালানোর চেষ্টা করেন আইএসের নারী সদস্যরা।
আল-হোল থেকে বের হয়ে আসতে ১৫ হাজার ডলারের বেশি খরচ হতে পারে। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই পাচারের পদ্ধতি, জাতীয়তা এবং সন্তানের সংখ্যার ওপর নির্ভর করছে।
সাধারণত ইদলিব প্রদেশের দালালরা পাচারের ব্যবস্থা করে থাকেন। তবে সব কার্যক্রমই জাতীয়তা এবং ভাষা ভেদে ভিন্ন। যেমন, রাশিয়ার ভাষাভাষী দালালরা কেবল রাশিয়ান ভাষার নারীদের সাথেই চুক্তি করেন।
বের হয়ে আসার সবথেকে ব্যয়বহুল পদ্ধতি হলো ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার। এসডিএফ এবং ইসলামিস্ট চেকপোস্টগুলোতে ঘুষ প্রদানের পর প্রথমে নারীদের ইদলিবের নিরাপদ কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। দ্বিতীয় আরেকটি উপায় হলো, পানির ট্যাংক, বাস বা অন্য কোনো যানবাহন শিবিরে প্রবেশ করলে ড্রাইভারের সাথে চুক্তি করে সেখানে লুকিয়ে বের হয়ে আসা।
সবথেকে, কম খরচে পালানোর উপায় হলো দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসা কিংবা রাতে গোপনের পালানোর চেষ্টা করা।
এসডিএফ পালিয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে পুরোপুরি অবগত। ঘুষের বিনিময়ে ক্যাম্পের নিরাপত্তারক্ষী বা কর্মীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করার বিষয়টিও তারা জানে।
আল-হোল ছেড়ে যাওয়া প্রায় প্রত্যেকেই প্রথমে ইদলিব প্রদেশে যান। ইদলিবের সাথে তুরস্কের সীমান্ত রয়েছে। যারা নিজেদের দেশে ফিরতে চান বা নতুন স্বামীর কাছে যেতে চান, তারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন। জাল পাসপোর্ট তৈরির মাধ্যমে এই কাজ করা হয়।
২০১৯ সালে তথাকথিত খেলাফতের পতনের সময় সিরিয়ায় আইএসের শেষ ঘাঁটিতে প্রায় ৬০ হাজার নারী ও শিশু ছিল। এখন এসব নারী ও শিশু যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের বন্দিশিবিরে রয়েছে। তাদের এই বন্দিদশায় ক্ষুব্ধ বিশ্বজুড়ে আইএস সমর্থকরা। অনেকে অনলাইনের মাধ্যমে বন্দি নারীদের বিয়ে করে তথাকথিত জিহাদিদের শ্রদ্ধা জানানোর একটি উপায় বলে মনে করছেন। এই সম্ভাব্য স্বামীদের অধিকাংশই মুসলিম দেশের হলেও তারা ইউরোপে বাস করেন এবং তাদের বেশ ভালো সম্পদ রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ