সমকামীদের অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে ফ্রান্স ঐতিহ্যগতভাবেই উদার এবং ইউরোপ ও সারা বিশ্বের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে। এবার সমকামী নারী এবং একক নারীও এখন থেকে সন্তান ধারণ করতে পারবে বলে এ বিষয়ে নতুন আইন পাস করেছে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট। খবর রয়টার্স, বিবিসি, ডয়েচে ভেলে
আইন অনুযায়ী, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আইভিএফ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান ধারণ করতে পারবেন সমকামী ও একক নারীরা। দীর্ঘ দুই বছর ধরে এই আইনটি নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (২৯ জুন) ফ্রান্সের পার্লামেন্ট আইনটিকে বৈধতা দেয়।
আইভিএফ বা চিকিৎসার মাধ্যমে প্রজননের জন্য পুরুষের সঙ্গে সহবাসের প্রয়োজন হয় না। ব্রিটেন, বেলজিয়াম ও স্পেনসহ ইউরোপের অনেক দেশেই সমকামী এবং সিঙ্গেল নারীরা এই পদ্ধতিতে সন্তান নিয়ে থাকেন। কিন্তু ফ্রান্সে এতদিন আইনটি চালু ছিল না।
পার্লামেন্ট অধিবেশনে ক্ষমতাসীন লা রিপাব্লিক এন মার্কে দলের সংসদ সদস্য কোরালি ডুবস্ট বলেন, আমরা এখানে স্বাধীনতা, সাম্যতা, সংহতি এবং মর্যাদার ভিত্তিতে তৈরি একটি আইনকে ভোট দিতে এসেছি।
বিদ্যমান ফরাসি আইনের আওতায়, আইভিএফ কেবল বন্ধ্যাত্বের কারণে বা কোনো রোগ বা চিকিত্সা বা পিতামাতার কাছে মেডিকেল অবস্থার সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকির কারণে বিপরীত লিঙ্গের দম্পতিদের জন্যই অনুমোদিত ছিল।
আইএফওপি জরিপে দেখা গেছে, দুই- তৃতীয়াংশ ফরাসি জনগণ এই আইনটি সমর্থন করছে।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, সমকামী নারী এবং একক নারীদের সন্তান ধারণের বৈধতা দিতে দেশটির ক্ষমতাসীন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সরকার দীর্ঘদিন ধরেই একটি আইন চালু করতে চাচ্ছিল। কিন্তু এ ধরনের কোনো আইনের তীব্র বিরোধিতা করছিলেন ম্যাক্রোঁর বিরোধীরা।
এরপর প্রায় দুই বছর ধরে এই আইনটি নিয়ে ফরাসি পার্লামেন্টে বিতর্ক হয়। সব মিলিয়ে আইনটির পক্ষে-বিপক্ষে প্রায় ৫০০ ঘণ্টার বিতর্ক হয়। ১২ হাজার বার আইনটির পরিবর্ধন এবং পরিবর্তন হয়েছে। শেষপর্যন্ত বিপুল ভোটে ফরাসি নিম্নকক্ষে আইনটি পাস হয়।
আইনের পক্ষে ভোট পড়েছে ৩২৬টি। বিপক্ষে ১১৫টি। দীর্ঘদিন রক্ষণশীল অধ্যুষিত সিনেটে আইনটি আটকে ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত মাক্রোঁ এবং তার মন্ত্রিসভার চেষ্টায় আইনটি পাস হয়।
ফ্রান্সে আইভিএফ চিকিৎসা এতদিন আইনসিদ্ধ ছিল। অর্থাৎ, স্বাভাবিক ভাবে সন্তান না হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সন্তান নেওয়ার ব্যবস্থা। এছাড়াও স্পার্ম ডোনারও (শুক্রাণুদাতা) আইনসিদ্ধ ছিল। কিন্তু একক নারী কিংবা সমকামীদের ক্ষেত্রে আইভিএফ চিকিৎসা আইনসিদ্ধ ছিল না।
যদিও ফ্রান্সে সমকামী বিয়ে বৈধ। আর তাই বিদেশে গিয়ে বহু নারী আইভিএফ চিকিৎসা করিয়ে সন্তান নিয়ে ফিরতেন। এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ফরাসি পার্লামেন্টে বিতর্ক চলছিল। শেষপর্যন্ত একটি আইন তৈরির কথা হয়। কিন্তু রক্ষণশীলরা কোনোভাবেই এই আইনের পক্ষে ছিলেন না।
আইভিএফ ট্রিটমেন্ট ছাড়াও এই আইনে বলা হয়েছে, স্পার্ম ডোনারের মাধ্যমে কারও সন্তান হলে সেই সন্তান ১৮ বছর বয়সে গিয়ে জানতে চাইতে পারে তার বায়োলজিক্যাল বাবা কে? প্রশ্ন এলে ঠিক উত্তর দিতে হবে। সন্তান চাইলে বাবার সঙ্গে দেখাও করতে পারে।
তবে সারোগেসি নিয়ে এই আইনে কোনো কথা বলা হয়নি। অন্য নারীর গর্ভে সন্তান রাখার পদ্ধতির নাম সারোগেসি। এ বিষয়ে নতুন আইনে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ট্রান্সজেন্ডারদের স্পার্ম ডোনেট করা নিয়েও নতুন আইনে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন ফ্রান্সের এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি। আইন পাস হওয়ার পরে তারা জানিয়েছেন, তারা খুশি। তবে এখনও সকল দাবিদাওয়া পূরণ হয়নি।
অন্যদিকে ফ্রান্সের এক মন্ত্রী জানিয়েছেন, দ্রুত আইনটিকে চালু করা হবে যাতে এ বছরের শেষেই সন্তানের মুখ দেখতে পান নারীরা।
ফ্রান্সকে বিশ্বের অন্যতম সমকামীবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে সবসময়ই ধরা হয়। জরিপে দেখা যায় যে অধিকাংশ ফরাসী মানুষ সম-লিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে হওয়াটাকে সমর্থন করে এবং ২০১৩ তে একটি জরিপ নির্দেশ করে যে ৭৭% ফরাসী মানুষ বলেন যে সমকামিতাটা সমাজ দ্বারা সমর্থিত হওয়া উচিত, যেই সমর্থন করার প্রবণতাটা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ।
অনেক সংবাদমাধ্যম প্যারিস শহরটিকে বিশ্বের অন্যতম সমকামীবান্ধব হিসেবে ধরেছে, প্যারিসের ‘লে মারাইস’, ‘কুয়ারটিয়ার পিগালে’ এবং ‘বইস ডে বউলগ্নে’ কে বলা হয় ‘সমৃদ্ধশালী সমকামী এবং হিজড়া’দের এলাকা এবং এ এলাকাগুলো সমকামীদের নৈশক্লাবের জন্য বিখ্যাত।
যদিও প্রাচীন যুগে ফ্রান্সে সমকামিতাকে একটি বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং এটার সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। ১৭৯১ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় সকল ‘সডোমী আইন’ (Sodomy শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ পায়ুকাম) বাতিল করা হয়। তারপরেও, একটি কমজানা ‘অশ্লীল পোশাক আইন’ ১৯৬০ সালে চালু করা হয় যেটার মাধ্যমে মাঝেমাঝেই সমকামীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হত, আইনটি ২০ বছর পর উঠিয়ে দেওয়া হয়। সম-লিঙ্গের মানুষের মধ্যে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে ন্যূনতম বয়স ১৫ করা হয় ১৯৮২ সালে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোয়াঁ মিটার্যান্ড এর আমলে।
সমলিঙ্গের যুগলদের জন্যে ‘ডমেস্টিক পার্টনারশীপ’ (যেটি ‘সিভিল সলিডেয়ারিটি প্যাক্ট-১৯৯৯’ হিসেবে পরিচিত) সুবিধা দেওয়ার পর ২০১৩ সালে ফ্রান্স বিশ্বের ১৩তম দেশ হিসেবে পরিগণিত হয় সম-লিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ের বৈধতার ক্ষেত্রে, দেশটিতে কিছুটা বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও।
১৯৮৫ সালে যৌন অভিমুখীতা এবং ‘লিঙ্গ পরিচয়’ এর ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবেনা এ মর্মে একটি আইন করা হয়। লিঙ্গ পরিবর্তনে ইচ্ছুক মানুষেরা তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারবেন, এটি আইনগতভাবে বৈধ এবং ২০০৯ সাল থেকে ফ্রান্স লিঙ্গ-পরিবর্তনের মন-মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে মানসিক রোগী আখ্যা দেওয়া বাদ দিয়ে দেয়, ফ্রান্সই পৃথিবীর প্রথম দেশ এই পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ