দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ই-বর্জ্য। গত ১০ বছরে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ গুণ। এই প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হচ্ছে ডাস্টবিনে। ফলে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থা এনভাইরনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের (ইএসডিও) গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ২০২৩ সালে এই ই-বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১২ লাখ টন। এখনই এর ব্যবস্থাপনা করা না গেলে সামনের দিনে বড় ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি করবে। দুই-একটি ছোট প্রতিষ্ঠান কিছু ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। তবে বড় পরিসরে এই উদ্যোগ নেওয়া না গেলে সংকট বাড়বে।
দেশে বছর বছর লাখ লাখ মুঠোফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশনার, ফটোকপি মেশিনসহ নানা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম অকেজো হয়ে যায়। সমস্যা হলো, এসব ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের পরিবেশসম্মত ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা নেই। সেগুলোর স্থান হয় অন্যান্য গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে আস্তাকুঁড় বা ডাস্টবিনে।
ই-বর্জ্যের পরিমাণ কত
বাংলাদেশে বছরে কী পরিমাণে ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, ধ্বংস ও পরিবেশে মিশে যায়, তা নিয়ে সরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো হালনাগাদ পরিসংখ্যান নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৮ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। এতে বলা হয়, ওই বছর দেশে ৪ লাখ টন বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন (ইলেকট্রনিকস) বর্জ্য জমা হয়। এর মধ্যে কেবল ৩ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইক্লিংশিল্পে ব্যবহার করা হয়। বাকি ৯৭ শতাংশের ঠাঁই হয় ভাগাড়ে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে প্রতিবছর ২০ শতাংশ হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ এই ই-বর্জ্য বছরে ৪৬ লাখ টনে দাঁড়াবে।
ই-বর্জ্য সারা বিশ্বেই বড় উদ্বেগের কারণ। ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক জোট গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট স্ট্যাটিসটিকস পার্টনারশিপের (জিইএসপি) এক হিসাব বলছে, বিশ্বে প্রতি পাঁচ বছরে ই-বর্জ্য ২১ শতাংশ হারে বাড়ে। ২০১৯ সালে সারা পৃথিবীতে ৫ হাজার ৩৬০ কোটি কেজি ই-বর্জ্য জমা হয়। সে বছর মোট উৎপাদিত ই-বর্জ্যের শুধু ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। ই-বর্জ্য বেশি জমা হচ্ছে নিম্ন আয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি ই-বর্জ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১৫ জুন প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে ই-বর্জ্য থেকে কার্যকর ও বাধ্যতামূলকভাবে শিশুদের রক্ষা করতে আহ্বান জানিয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, ই-বর্জ্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের রক্ষা করতে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুসকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদিত হয়। আবার বিপুল পরিমাণ পণ্য ফেলে দেওয়া হয়। এতে পৃথিবীজুড়ে ‘ই-বর্জ্যের সুনামি’ চলছে। মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছে। একই সঙ্গে প্লাস্টিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের বিপরীতে সমুদ্র এবং তার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সারা পৃথিবী এখন সরব। ই-বর্জ্যের ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে মূল্যবান সম্পদ ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্বে ১ কোটি ২৯ লাখ নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য খাতে নিয়োজিত। এ সংখ্যক নারী ও তাদের অনাগত সন্তানদের বিষাক্ত ই-বর্জ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরের একটা বড় অংশের বয়স পাঁচ বছরের নিচে, যারা সক্রিয়ভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের সঙ্গে যুক্ত আছে।
কী করছে সরকার
ই-বর্জ্যের এই ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে আরও ১০ থেকে ১৫ বছর আগে। তবে এত দিনে পরিবেশ অধিদপ্তর একটি বিধিমালা করেছে। ১০ জুন বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর অধীনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামের বিধিমালাটির গেজেট প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়, এখন থেকে বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্য থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানকেই ফেরত নিতে হবে। নষ্ট হওয়া মুঠোফোন, ল্যাপটপ থেকে যেকোনো বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্য প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দিলে ভোক্তারা বিনিময়ে টাকা পাবেন। এ ক্ষেত্রে একটি লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে উৎপাদিত ই-বর্জ্যের ৫০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে।
এই বিধিমালায় গৃহস্থালি ও মেডিকেল সরঞ্জামের পাঁচ শ্রেণির ৭১টি বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্যে বিপজ্জনক পদার্থ ব্যবহারের মানমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ই-বর্জ্য কীভাবে পরিবহন করা হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারা উল্লেখ নেই। শুধু ধারা ১৮-তে বলা আছে, ‘ই-বর্জ্য পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পরিবহন করতে হবে।’
উৎপাদনকারীকে ফেরত নিতে হবে ই-বর্জ্য
ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য বা ই-বর্জ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানকেই ফেরত নিতে হবে। আর ব্যবহারের পর নষ্ট বা বাতিল মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ ই-বর্জ্য ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে অর্থ পাবেন ব্যবহারকারী। এমন শর্ত রেখেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ প্রণয়ন করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। গত ১০ জুন বিধিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এর আগে বিধিমালাটি জারি করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
এই বিধিমালার ফলে বিদেশ থেকে এখন আর কেউ পুরনো বা ব্যবহৃত মোবাইল বা ল্যাপটপ আনতে পারবেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে দিন দিন বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ফলে সরকারের এই বিধিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না।
কীভাবে এই আইনটি বাস্তবায়ন করা হবে? জানতে চাইলে বিধিমালা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন) মির্জা শওকত আলী বলেন, ‘এখন আমরা আইনটির বিষয়ে সবাইকে অবহিত করছি। আগামী মাসেই সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনা করা হবে।’ ব্যবহারকারী ব্যবহৃত ই-বর্জ্য ফেরত দিয়ে কত অর্থ পাবেন সেটা কে ঠিক করবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা বিধিমালায় রাখিনি। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হবে মোট মূল্যের এক বা দুই শতাংশ অর্থ ব্যবহারকারী পাবেন। অর্থাৎ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা একটি ফোন ব্যবহারের পর ফেরত দেওয়া হলে ২০০ বা ৪০০ টাকা ব্যবহারকারী পাবেন। আলোচনা করেই এটা ঠিক করা হবে।’
বিধিমালার কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)’ এর ১৫ (১) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে দুই থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মির্জা শওকত আলী বলেন, বিধিমালায় প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও বড় আমদানিকারকের ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালা বাস্তবায়নের প্রথম বছর প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও বড় আমদানিকারককে উৎপাদিত ই-বর্জ্যের ১০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয় বছরে ২০ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ৩০ শতাংশ, চতুর্থ বছরে ৪০ শতাংশ ও পঞ্চম বছরে ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এটা করেছি।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহ কেন্দ্র, মেরামতকারী এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী ই-বর্জ্য ১৮০ দিনের বেশি মজুত রাখতে পারবে না। কিছু ক্ষেত্রে আবেদনকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তর আরও ৯০ দিন পর্যন্ত বাড়াতে পারবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো পুরোনো বা ব্যবহৃত ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করা বা দান-অনুদান বা অন্য কোনোভাবে বিদেশ থেকে আনা যাবে না। তবে গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য অধিদপ্তরের অনাপত্তি নিয়ে গ্রহণ করা যাবে।
মোস্তাফা জব্বার ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে বলেছেন, এর জন্য বিজনেস প্ল্যান বা ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যাতে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়। তাহলে এটা আর ঝুঁকিপূর্ণ থাকবে না। তার মতে, দিনে দিনে ই-বর্জ্য কমানো যাবে না, আমাদের ইলেকট্রনিক্স ও ডিজিটাল পণ্যের ব্যবহার আরো বাড়বে। পুরনো প্রযুক্তি বাদ দিয়ে নতুন প্রযুক্তিতে যেতে হবে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাও করতে হবে।
দেশে সীমিত পরিসরে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করছে দুটি প্রতিষ্ঠান। এর একটি এনএইচ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হায়দার বলেন, টেলিকম অপারেটর থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। আমরা সীমিত পরিসরে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীদের দিয়ে পুরোনো হ্যান্ডসেট কিনে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করছি। তার মতে, এর জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও বড় আয়োজন দরকার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত, যন্ত্র ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি শেখা। এতে মোবাইল, ল্যাপটপ ও ট্যাব বেশি দিন ধরে ব্যবহার করা যাবে। গুরুত্ব দিতে হবে পুরোনো সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানোর ওপরে। একই যন্ত্র একাধিক কাজ করবে, এমন মাল্টিপারপাস ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। একই চার্জারে সব সংস্থার সব মডেলের মোবাইল চার্জ করা যায়, এমন চার্জারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ইউনিফর্মের ব্যবহার, নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কিছুটা সুফল মিলবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে, যা সমাধানের লক্ষ্যে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ই-বর্জ্যেরে কারণে ঘটছে জলবায়ুর পরিবর্তন। এটা বিশ্বব্যাপীই ঘটছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এফএ/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ