প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবীর। এ পরিবর্তনের ধারায় কখনও ঘূর্ণিঝড়, কখনও ভূমিকম্প, কখনও অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, কখনও বন্যা, কখনও বিভিন্ন রোগ-বালাই দুর্যোগ আকারে দেখা দিচ্ছে। মারা যাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঠের পর মাঠ ফসল। বাড়ছে খাদ্য সংকট। ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে। ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মাথা গোঁজার ঠাঁই। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কু-প্রভাব বিশ্বে মরুকরণের একটি অন্যতম সমস্যা।
জাতিসংঘের একটি খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মানব স্বাস্থ্যের মারাত্মক পরিণতি বহন করতে হবে, আগামী কয়েক দশকে বিশ্বে ক্ষুধা, খরা ও রোগে ভুগবে কয়েক কোটির বেশি মানুষ।
করোনায় বিশ্ব ভয়াবহ একটি বছর পার করেছে। এরই মধ্যে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনে আগামী কয়েক দশকের ভয়াবহ অবস্থার পূর্বাভাস এসেছে।বলা হয়েছে, আগামী দশকগুলোতে অপুষ্টি, পানির নিরাপত্তাহীনতা ও মড়কের মতো বিষয়গুলো মানুষকে ভোগাবে।
সম্ভাব্য সংকটের মাত্রা কমিয়ে আনতে উদ্ভিদ থেকে পাওয়া খাবারের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর মতো নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এদিকে শস্য উৎপাদন কমে যাওয়া, মৌলিক খাবারের পুষ্টিগুণ কমে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি বিশ্বে অসহায় মানুষগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মানুষ কতটা কার্যকরভাবে কার্বন নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে পারবে তার ওপর আগামী ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আজ যে শিশুটি জন্ম নিচ্ছে, ৩০ বছর বয়স হওয়ার আগেই নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হবে তাকে।
আইপিসির ৪ হাজার পৃষ্ঠার এই খসড়া প্রতিবেদন আগামী বছর চূড়ান্ত আকারে প্রকাশ পাবে। এই প্রতিবেদনেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকবে।
প্রতিবেদনে আরো পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৮ কোটি মানুষ খাবারের অভাবে মারা যাবে।
প্রতিবেদনে পানি চক্র ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। এছাড়াও ধারণা করা হচ্ছে আফ্রিকা অঞ্চলে বৃষ্টিনির্ভর শস্য উৎপাদন কমে যাবে। এমনকি ভারতে ৪০ শতাংশ ধান উৎপাদন কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ১৯৮১ সালের তুলনায় বিশ্বে ভুট্টা উৎপাদন ইতিমধ্যে ৪ শতাংশ কমে গেছে। এমনকি হঠাৎ করেই বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন ৫০ বছরে ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক মারিয়া নেইরা বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি তিনটি খুঁটির ওপর নির্ভর করে। এগুলো হচ্ছে আমরা যা খাই, যে পানি ব্যবহার করি এবং যেখানে বসবাস করি। এই খুঁটিগুলো পুরোপুরি নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে এবং সেগুলো ভেঙে পড়তে পারে।’
আইপিসিসির প্রতিবেদনে জড়িত নয় এমন ওয়ার্ল্ড রিসোর্সস ইনস্টিটিউটের জলবায়ু রেসিলেন্সে অনুশীলনের গবেষণা সহযোগী স্টেফানি টাই বলেছেন, কোভিড আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ত্রুটিযুক্ত রেখাগুলিকে অত্যন্ত দৃশ্যমান করে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং ধাক্কা আরও দীর্ঘতর সময়ের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও বেশি চাপ দেবে এবং যে পদ্ধতিতে আমরা এখনও পুরোপুরি উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।
ফিনল্যান্ডের আলতো ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা সম্প্রতি এক গবেষণায় জানিয়েছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ ঝুঁকিতে পড়বে।
গবেষকেরা বলেছেন, বর্তমানে শস্য উৎপাদনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর ৯৫ শতাংশ ‘জলবায়ু নিরাপদ অঞ্চল’ অথবা ‘পরিবেশের’ মধ্যে পড়ে। তাপমাত্রা যদি ৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে এই অঞ্চলগুলোর অনেক স্থানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনের এই অঞ্চলগুলো ব্যাপকভাবে সংকুচিত হবে।
গবেষণার প্রধান লেখক ও আলতো ইউনিভার্সিটির বৈশ্বিক খাদ্য ও পানিবিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক মাত্তি কুম্মু বলেছেন, ‘জলবায়ু সংকটে বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়বে। জলবায়ু নিরাপদ অঞ্চল ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়ে আসার আভাস আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের। কিন্তু আমাদের হাতে এখনো সময় আছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে পারি আমরা। এ ছাড়া ঝুঁকির প্রভাব কমাতে এবং সহনশীলতা ও অভিযোজনের সক্ষমতা বাড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজন ও সমাজকে শক্তিশালী করা উচিত।’
মাত্তি কুম্মু বলেছেন, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পশুপালনের পাশাপাশি খাদ্যশস্য উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। অনেক এলাকায় ব্যাপক আকারে পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্যগুলোর মধ্যে ২৭টি এবং সাত ধরনের গবাদিপশুর ওপর প্রভাব হবে মারাত্মক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মরুকরণ যেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মাথা ব্যাথার কারণ তেমনি আমাদেরও উদ্বেগের যথেষ্ঠ কারন রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আমাদের ফসলি জমি কমে পরিবেশের ভারসম্য নষ্ঠ হচ্ছে। একই সংগে কমছে গাছ-পালা, বন-জঙ্গল। তার চেয়ে বড় বিষয় আমাদের নদী হলো শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য জলাধারের অবস্থাও সঙ্খিন। দিন দিন যেমন আমাদের ফসলি জমি কমছে, একই সঙ্গে খরায় উর্বরতা হারাচ্ছে জমি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় পরিবেশের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।
তারা বলেন, মরুকরণ এতোদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও এখন এটি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ঠ ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্পান, ফণী, সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ এই ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ