কর্পোরেট বিশ্বে শোষণ তোষণের নতুন হাতিয়ার গণমাধ্যম। তথ্য এই মুহূর্তে বিশ্বের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট। তা সে রাষ্ট্র পরিচালনা হোক আর বাদাম বেচা। যেকোন ঘটনায় জনমানুষের মতামত তৈরিতে সবথেকে কার্যকর অনুঘটক এই তথ্য। এবার মনে হতে পারে এই তথ্য কতটা অথেনটিক, কতটা ফেব্রিকেটেড, তা নির্ভর করছে গণমাধ্যমের উপর। কিন্তু এটা আদতে ‘ডাহা মিথ্যা’। গণমাধ্যম এই সময়ে কর্পোরেট বিশ্বের মুখ হয়ে উঠেছে। প্রভাবশালী শিল্পপতিরাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে কোনও তথ্যের কতটা সাধারণ মানুষের সামনে আসবে কিংবা কীভাবে তা উপস্থাপন করা হবে।
কিন্তু ওই যে, স্রোতের বিপরীতে আর মজলুমের পক্ষে সবসময় একদল মানুষ থাকেই। তাই গণমাধ্যমকে করাপ্টেড করা গেলেও, কোনও করাপ্টেড সিস্টেমের দাস হতে রাজি নয় সাংবাদিকেরা। আর তাই সাম্প্রতিক সময়ে দেশ তোলপাড় করা ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা পরিমনির সাথে ঘটা ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানের জন্য ‘দৈনিক জাগরণ এবং জাগরণ অনলাইন’ থেকে গণ-অব্যাহতি নিয়েছেন সাংবাদিকেরা। ১৮ জন সাংবাদিকের সাক্ষরকৃত এই গণ-অব্যাহতিপত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সবার নজরে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘সামষ্টিক স্বার্থের পরিপেক্ষিতে (আজ ১৭ জুন, ২০২১) আমরা আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যাহতি নিচ্ছি’।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক ফিরোজ আহমেদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্টে লেখেন, “ভালোবাসা, এই অসাধারণ কাজটার জন্য। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করলেন এরা। নানান পথের ও মতের পথিক হয়তো এরা সকলে, কিন্তু ন্যূনতম যে নীতির ভিত্তিতে মানুষ বাঁচে, সেই ডাকে তারা সাড়া দিয়েছেন। যারা কাজটা করতে পারেননি, কিন্তু আত্মপীড়নে আছেন, তাদের প্রতিও ভালোবাসা থাকলো।
দৈনিক জাগরণ থেকে পদত্যাগ করেছেন এরা একযোগে, বোঝাই যায় পরিমনি প্রশ্নটাতে দৈনিকটির কুৎসিত প্রতিবেদনগুলোর প্রতিবাদে।
তাদের লড়াই অন্যদের উদ্দীপ্ত করুক। বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে এই মোসাহেব সম্পাদকরা নামাতে নামাতে অনেকদূর নিচে নামিয়েছেন, সাংবাদিকতা পেশাটিকে রক্ষার স্বার্থেই গণমাধ্যমকর্মীদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
গণমাধ্যমকর্মীদের এই ঘটনাটি কেন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ? কারণ গুম হওয়া, খুন হওয়া, নিপীড়িত হওয়া, ধর্ষিত হওয়া, এবং ক্ষমতাবান না হলে বিচার না পাওয়া বাংলাদেশের নিত্যদিনের ঘটনা।
প্রতিবাদের চিহ্নগুলো ক্রমশঃ কমে আসছে। এই গণপদত্যাগ অনেক বড় একটা স্মারক, সেই বিবেচনায়।
ঈসা নবী বলেছিলেন, মানুষ কেবল রুটি খেয়ে বাঁচে না। জান, জবানের স্বাধীনতার জন্য লড়াই আরও জোরদার হোক।”
এদিকে, গণ-অব্যাহতিপত্রে সাক্ষর করা, জাগরণের সিনিয়র সাব-এডিটর প্রণব আচার্য্য ফেসবুকে লেখেন, “সকলের স্বার্থেই আজ (১৭ জুন ২০২১) বিকালে আমরা অনলাইন টিম আবেদ খান সম্পাদিত জাগরণ পত্রিকা থেকে একযোগে গণ-পদত্যাগ করলাম। আজকের পর থেকে জাগরণ অনলাইনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো বিষয়ের সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত থাকবো না। জাগরণে প্রকাশিত কোনো ধরনের সংবাদ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়ও আমরা নেব না। নতুন কিছুর অপেক্ষায়…।”
এদিকে কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ফাইজ তাইয়েব আহমেদ দৈনিক জাগরণের সংবাদকর্মীদের গণপদত্যাগ সম্পর্কে ফেসবুকে মন্তব্য করে বলেন, “আবেদ খান গুমের ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করতে দেয় নাই। সেল্ফ সেন্সরশীপের কারনে সাংবাদিকরাও বিরক্ত হয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “দৈনিক জাগরণ থেকে পদত্যাগ করেছেন এরা একযোগে, বোঝাই যায় পরিমনি প্রশ্নটাতে দৈনিকটির কুৎসিত প্রতিবেদনগুলোর প্রতিবাদে।”
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সেল্ফ সেনসরশীপ খুবই প্রচলিত ব্যাপার এখন। এর অন্যতম কারণ ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট। কঠোর এই অনলাইন আইনে ২০২০ সালে ৭৫ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস এর তৈরি করা স্বাধীন গণমাধ্যমের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে নিচে অবস্থান করছে— ১৫২ তম। এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকেরা নিজেরদের চারপাশেই সেল্ফ সেনসরশীপের এক অদৃশ্য জাল বুনে ফেলেছে।
তবে যখন একের পর এক স্ক্যান্ডালে শিল্পপতিদের নাম উঠে আসছে এবং একই সাথে অন্ধকার জগতে তাদের সরব উপস্থিতির কথা সামনে আসছে সাধারণ মানুষের, তখন গণমাধ্যমের গলায় দড়ি পরিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে মরিয়া। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪৮ টি মিডিয়ার ৪০ টির মালিকপক্ষ ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি। এর ফলে দেশের ব্যবসায়িক আইকনেরা যেকোন ক্ষেত্রেই তাদের ব্যবসায়িক সহকর্মী, যারা মিডিয়া হাউজের সাথে জড়িত, কোন ঘটনার মোড় বদলে দিতে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে।
সাংবাদিকেরা অনেকটাই তাদের হাতের ইশারায় নাচা পুতুল। তবে এই অঘোষিত দাসত্বের শেকল পরতে রাজি না সাংবাদিকেরা। সত্যকে ধামাচাপ দিতে পুঁজিপতিদের নীলনকশার অংশ হবেন না তারা। আর তাই তাদের এই গণ-পদত্যাগ। এ যেন গণমাধ্যমের উপর শিল্পপতিদের অদৃশ্য দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের ধর্মযুদ্ধ।
এসডব্লিউ/এসএস/২০০৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ