কোভিড মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোকে মাত্র ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ । কিন্তু জোটের এই প্রস্তাবে নাখোশ জাতিসংঘ। এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয় সংস্থা-ইউএনওসিএইচএর প্রধান মার্ক লোকক। তার দাবি, আগামী বছর পর্যন্ত এই ১০০ কোটি ডোজ দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছে, তা ‘ছোট পদক্ষেপ’। রয়টার্সের খবর
জি-৭ এর পক্ষ থেকে টিকা সহায়তা আশ্বাসের পরই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে নানা মহলে। এমনকি টিকা বিতরণ নিয়ে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
জি-৭-এর গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে মার্ক লোকক বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবিলায় গরিব দেশগুলোর জন্য বিক্ষিপ্ত, ছোট আকারে যেসব দাতব্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর ফলে করোনা মহামারি বিদায় নেবে না। জরুরি ভিত্তিতে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে জি-৭ জোট।
ব্রিটেনের ইংল্যান্ডের কর্নওয়াল জেলায় (কাউন্টি) ১১ জুন থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বের সমৃদ্ধ অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি ৭ এর সম্মেলন। এই জোটের সদস্যরাষ্ট্রগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি, জাপান ও ইতালি।
সম্মেলন শুরুর প্রথমদিনই জি৭ নেতারা ঘোষণা করেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ করোনা টিকা দেবে জি৭; কিন্তু ঘোষণা দেওয়ার পরই এর তীব্র সমালোচনা শুরু করে বৈশ্বিক দাতা সংস্থাগুলো ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, ধনী দেশগুলো যে পরিমাণ টিকার ডোজ দিচ্ছে, তা দিয়ে দরিদ্র দেশগুলোর জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে না।
এর প্রেক্ষিতে মার্ক লোকক জানান, জি-৭ জোটের দেশগুলো খুব ক্ষুদ্র পদক্ষেপ নিয়েছে। এর থেকে বড় পদক্ষেপ তাদের নিতে হবে। সারা বিশ্বের জনগণকে কীভাবে টিকা দেওয়া হবে, তার একটি পরিকল্পনা জি-৭ জোটের কাছ থেকে পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ব পেলো মাত্র ১০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা।
এর আগে জি-৭ এর এই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট নয় বলে সাফ জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বিশ্বের জন্য অনেক বেশি টিকার প্রয়োজন। টিকার ঘাটতি দূর না করা গেলে এই ভাইরাস সামনে অধিক শক্তিশালী ও সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে।
উন্নত দেশগুলোকে সতর্কবার্তা দিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণকে যদি দ্রুত টিকার আওতায় না আনা যায়, সেক্ষেত্রে সার্স-কোভ-২ বা করোনাভাইরাসের অভিযোজনের হার ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।
এর ফলে, প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটির এমন অনেক নতুন অভিযোজিত ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) পৃথিবীতে দেখা দিতে পারে, যেগুলোর ক্ষেত্রে বাজারে বর্তমান প্রচলিত করোনা টিকাগুলো কোনো কাজে আসবে না।
বিবৃতিতে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আমাদের আরও বেশি টিকার ডোজ প্রয়োজন এবং পাশাপাশি প্রয়োজন একটি বৈশ্বিক টিকাদান পরিকল্পনা। মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে অবশ্যই আমাদের যৌক্তিক পথে এগোতে হবে।’
‘বর্তমানে আমরা এক ধরনের জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি। যুদ্ধ অর্থনীতিতে যেমন সমরাস্ত্র নির্মাণকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা টিকার উৎপাদন ও বিতরণকেও আমাদের সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও আমরা এই বোধ থেকে অনেক দূরে আছি।’
যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে কমপক্ষে ১০ কোটি টিকা বিতরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৫০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিতরণের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অন্যদিকে ১০ কোটি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে কানাডা।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড জি৭-এর টিকা বিতরণ প্রতিশ্রুতির সমালোচনা করে বলেন, ‘১০০ কোটি ডোজ করোনা টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি মহাসাগরে মাত্র একফোঁটা পানি দেওয়ার মতোই। এ দিয়ে ভারতেরই পুরো জনসংখ্যাকে টিকার আওতায় আনা যাবে না, বাদবাকি বিশ্ব তো দূরের কথা।’
আন্তর্জাতিক মানবিক সহযোগিতা ও দাতাসংস্থা অক্সফামের স্বাস্থ্যনীতি ব্যবস্থাপক আন্না ম্যারিয়ট কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘যদি জি৭ নেতারা তাদের বৈঠকে মাত্র ১০০ বিলিয়ন ডোজ করোনা টিকা বিতরণের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছান, তাহলে আমরা বলব এবারের বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রয়োজন অন্তত ১১০০ কোটি ডোজ করোনা টিকা।’
তবে জি৭-এর টিকা বিতরণ ঘোষণার সবচেয়ে কঠিন সমালোচনা করেছেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন। শনিবার এক বার্তায় তিনি বলেন, ‘জি-৭ নেতাদের প্রতিশ্রুতি অনেকটা সংকটের প্রকৃত সমাধান করার চাইতে বরং ভিক্ষার ঝুলি এক হাত থেকে অন্য হাতে পার করার মতোই ব্যাপার।’
এদিকে গত ৯জুন ডয়েচে ভেলেকে পাঠানো এক লিখিত বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত টিকা সরবরাহ করা হয়েছে তার ৭৫ শতাংশই পেয়েছে মাত্র ১০টি দেশ। কম জিডিপির দেশগুলো পেয়েছে এক শতাংশেরও কম টিকা।
বিবৃতিতে ডব্লিউএইচওর পক্ষ থেকে বলা হয়, উন্নত দেশগুলো যেখানে তাদের নাগরিকদের অর্ধেকেরও বেশি অংশকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছে সেখানে বিশ্বের অনেক দেশ এখন পর্যন্ত টিকার ডোজের অভাবে টিকাদান কর্মসূচি শুরুই করতে পারেনি।
উদাহারণ হিসেবে বিবৃতিতে বলা হয়, জার্মানির ৪৫ শতাংশ মানুষ ইতোমধ্যে করোনা টিকার অন্তত একটি ডোজ পেয়েছেন। কিন্তু তাঞ্জানিয়া, চাদসহ অনেক দেশ এখন পর্যন্ত টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে পারেনি; কারণ এই দেশগুলোর কাছে কোনো টিকা নেই।
সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে ২০২০ সালে গ্যাভি ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউটসহ কয়েকটি দাতা সংস্থার সহযোগীতায় কোভ্যাক্স প্রকল্প চালু করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই প্রকল্পের আওতায় বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ করা হচ্ছে, তবে তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম।
কোভ্যাক্স প্রকল্পের জন্য টিকা কিনতে অবশ্য দাতা দেশগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছে ডব্লিউএইচও। এ লক্ষ্যে গত সপ্তাহে অনলাইনে একটি ভার্চুয়াল সম্মেলনেরও আয়োজন করে সংস্থাটি। সম্মেলনে বিভিন্ন দাতা দেশের প্রতিনিধিরা করোনা টিকা ক্রয়বাবদ ১৯ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা দেওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন।
তবে জটিলতা দেখা দিয়েছে অন্য জায়গায়। বিভিন্ন দেশ কোভ্যাক্সে টিকা না দিয়ে কৌশলগত স্বার্থের বিষয় বিবেচনা করে সরাসরি বন্ধু দেশকে টিকা দিচ্ছে।
ডব্লিউএইচও সূত্র ডয়েচে ভেলেকে জানিয়েছে, দাতাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, তাতে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ১৫ কোটি ডোজ করোনা টিকা বিতরণ করতে পারবে কোভ্যাক্স। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য ছিল, চলতি বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৫ কোটি ডোজ টিকা বিতরণ করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ