করোনাকালে রেহাই দিচ্ছে না খাদ্যমূল্য। আর্থিক পরিস্থিতি না শোধারালেও বেড়েই চলেছে খাবারের জিনিসের দাম। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্যমূল্যের সূচক বলছে, গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ খাবারের মূল্য বেড়েছে এপ্রিল থেকে মে মাসে। আর এভাবে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন-জীবিকাকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে কভিড-১৯ মহামারী।
এদিকে, বেহাল দশা অর্থনীতির। অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থা শোচনীয়। বাড়ছে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা। দরিদ্র এসব জনগোষ্ঠীর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে যাচ্ছে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। পাশাপাশি এই করোনা মহামারিতে কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বিপরীতে খাদ্যপণ্যের বাজার চড়া। চাহিদা মেটাতে ব্যয় হচ্ছে বাড়তি অর্থ। তবু বিশ্বের একটা বড় অংশের খাদ্যচাহিদা পূরণ হচ্ছে না।
কতটা চড়া খাদ্যপণ্যের বাজার?
টানা ১২ মাস বেড়েই চলেছে বিশ্বের খাদ্যমূল্য। মে মাস পর্যন্ত হিসেব বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি বেড়েছে খাদ্যের দাম। এই তথ্য দিচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্যমূল্যের সূচক। এদিকে, এফএওর মাসভিত্তিক খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক অনুসারে মে মাসে দাম ১০ বছরের সর্বোচ্চে ছিল। প্রায় সব ধরনের কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি খরচেও কৃষকের আগের তুলনায় খরচ বেশি হচ্ছে। এতে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও দাম বাড়ছে। এর ওপর যুক্ত হয়েছে আমদানিতে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি। সব মিলিয়ে চলতি বছরে বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যপণ্যের ব্যয় মেটাতে বেশ বেগ পোহাতে হবে দরিদ্র দেশগুলোর।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। যাতে দরিদ্র দেশগুলো আরো বেশি সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এফএও সম্প্রতি তাদের ষাণ্মাসিক ফুড আউটলুক প্রতিবেদনে বলছে, চলতি বছরে বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাবে। যার অন্যতম প্রভাবক হবে জাহাজীকরণের বাড়তি ব্যয়।
সব মিলিয়ে এ বছর খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় ১ দশমিক ৭১৫ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছতে পারে। যেখানে গত বছর ব্যয় ছিল ১ দশমিক ৫৩০ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি ডলার। সেই হিসাবে এ বছর খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়তে পারে ১২ শতাংশ।
প্রতিবেদন বলছে, মহামারীর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রয়েছে। তবে ২০২০ সালের শেষ দিকে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। দাম বৃদ্ধির এ ধারা আমদানি নির্ভর দেশগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করবে।
অন্যদিকে এফএওর ন্যাশনস ক্লাসড অ্যাজ লো ইনকাম ফুড ডেফিসিট কান্ট্রিজ প্রতিবেদনের পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছরে খাদ্য আমদানিতে ব্যয় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো। দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তা আরো হুমকিতে ফেলেছে মহামারী। এরই মধ্যে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আরো বাড়াবে বলে সতর্ক করছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংগঠনগুলো।
ক্ষুধার্ত থাকছে ৪৯ মিলিয়ন মানুষ
করোনা পরিস্থিতির জেরে বিশ্বে মোট জনসংখ্যার অন্তত ১০ শতাংশ খুব শিগগিরই নিজেদের খাদ্য সুরক্ষা হারিয়ে ফেলবেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংখ্যাটা বাড়বে। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ একটি ভিডিও বার্তায় বলেছেন, “এখনই শক্ত হাতে রাশ না ধরলে খাদ্য ব্যবস্থায় জরুরি অবস্থা শুরু হবে এবং শিশু থেকে বড় সকলের উপর তা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যাবে।”
প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট খাদ্যপণ্য মজুত আছে। কিন্তু খাদ্যবন্টন ব্যবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে সকলের ঘরে খাবার পৌঁছচ্ছে না। এর নেপথ্যে করোনা পরিস্থিতি। তাতেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বাড়ছে। দিন শেষে পেটে খিদে নিয়েই ঘুমোতে যেতে হচ্ছে অনেককে। বিশ্বের ৪৯ মিলিয়ন মানুষই এই স্তরে পড়ছেন। ২০ শতাংশ শিশুকে থাকতে হবে অভুক্ত অবস্থায়।
রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিবের মত, অন্যান্য মহামারী পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারও খাদ্যসংকট এবং অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে লড়াইয়ে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেই। তবে এবারের সমস্যাটা অন্যবারের চেয়ে যে কিছুটা কঠিন, তাও মানছেন রাষ্ট্রসচিব। তাই চিন্তা এবার বেশি। করোনার হাত ধরে আসছে বড়সড় খাদ্য সংকট।
কেন এতটা চাঙ্গা খাদ্যপণ্যের বাজার?
মূলত খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যপণ্যের বাজার এতটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সংস্থার অন্য একটি সূচক বলছে, খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় মার্চে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে ফ্রেইট ব্যয় বেড়েছে। সবমিলিয়ে গেল মার্চে রেকর্ড আমদানি ব্যয় হয়েছে, যা ২০০৬-০৮ ও ২০১০-১২ সালের মূল্যবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে। অবস্থা এতটা শোচনীয় যে, মূল্যস্ফীতির চাপে আর্জেন্টিনা ও রাশিয়ার মতো অনেক দেশ রফতানি কমিয়ে আনছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্যমূল্যের সূচক বলছে, গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ খাবারের মূল্য বেড়েছে এপ্রিল থেকে মে মাসে। ৪.৮ শতাংশ মূল্য বেড়েছে এই মাসে। যা সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংগঠনের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ আবদুলরেজা আবাসেইন বলেন, হঠাৎ করে ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা বেড়ে গিয়েছে চিনে। পাশাপাশি ব্রাজিলের খরা প্রভাব ফেলেছে খাবারের মূল্য বৃদ্ধিতে। এ ছাড়াও ভেজিটেবিল অয়েল, চিনি ও খাদ্যশস্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বের খাদ্যমূল্য বেড়ে গিয়েছে।
এফএও বলছে, বিশ্বব্যাপী গত বছর প্রধান খাদ্যপণ্য আমদানির পরিমাণ বেড়েছে, এরই মধ্যে যা আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে ৩ শতাংশের মতো। আর গত বছর খাদ্যপণ্যের চাহিদা ও মূল্যবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে চীন। দেশটিতে পশুদের মধ্যে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় খাদ্যশস্যের আমদানি কমিয়ে দেয় বেইজিং। তবে পরিস্থিতি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিপণ্য আমদানির পরিমাণ আবারো বাড়াতে শুরু করেছে দেশটি। যে কারণে আগামী ২০২১-২২ মৌসুমে কেবল ভুট্টা আমদানির পরিমাণ রেকর্ড বাড়াচ্ছে তারা। এফএও বলছে, আগামী মৌসুমে চীন ২ কোটি ৪০ লাখ টন ভুট্টা আমদানি করতে পারে। ফলে খাদ্যশ্যসটির আমদানিতে এবারো শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখবে চীন। চাহিদার এমন উল্লম্ফন খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছে এফএও।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১২৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ