কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের অনেকেই অবসাদ, দুশ্চিন্তা, স্ট্রেসের মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু শরীরের চিকিৎসা নয়, মনের চিকিৎসারও প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের হাওড়ার একটি হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব মেডিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেটা ম্যানেজমেন্টের তিন গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র।
সেখানে দেখা গেছে, প্রবীণদের চেয়ে করোনাক্রান্ত তরুণরাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন বেশি। অর্থাৎ মনের জোরের নিরিখে অধিক বয়সী কোভিড আক্রান্তরা হারিয়ে দিচ্ছেন তরুণ প্রজন্মকে।
শুভাশিস মিত্র, ডালিয়া মিত্র এবং অভিজিৎ দত্ত নামের ওই তিন গবেষক দেখিয়েছেন, কম বয়সীদের মধ্যেই মানসিক উপসর্গ বেশি দেখা দিচ্ছে। তাদের গবেষণাপত্রটি ‘এশিয়ান জার্নাল অব ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল রিসার্চ’ নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, মহামারি পরিস্থিতি যে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা করছেন চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। নিজে বা পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হওয়া, চারদিকে চলতে থাকা মৃত্যু মিছিল, আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকে মানুষকে সহজেই গ্রাস করছে অবসাদ, দুশ্চিন্তা। হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করারও উপায় নেই। ফলে তাদের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা আরও বেশি।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই পরীক্ষার জন্য ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি অ্যান্ড স্ট্রেস স্কেল ২১ (ডিএএসএস-২১) নামক একটি বিশেষ মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে দুশ্চিন্তা, অবসাদ ও স্ট্রেস মাপা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারী ১১৪ জন রোগীকে ২১টি প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর শূন্য থেকে চারের মধ্যে দিতে হয় তাদের। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ৭৫ জন পুরুষ এবং ৩৯ জন মহিলা। তাদের সবার বয়স ছিল ১৯ থেকে ৮২-এর মধ্যে। তারা প্রায় সকলেই কর্মরত এবং ভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে আসা।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে, এই রোগীদের মধ্যে অবসাদ, দুশ্চিন্তা এবং স্ট্রেসের হার যথাক্রমে ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ, ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বয়স কমার সঙ্গে সঙ্গে এই হারও বেড়ে যাচ্ছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এর আগেও বিশ্বের নানা প্রান্তে নিভৃতবাসে থাকা করোনা রোগী এবং সদ্য সেরে ওঠা রোগীদের ওপর এমন গবেষণা করা হয়েছিল। এই রোগীদের অবসাদ, দুশ্চিন্তার হার ছিল অনেক কম।
এবারের দ্বিতীয় ঢেউ তরুণ প্রজন্মের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে। সমাজের শৌর্য-বীর্যের প্রতীক তরুণ প্রজন্মকে এতদিন মোটামুটি সুরক্ষিত ভাবা হলেও এখন বাস্তবতা ভিন্ন। তরুণ জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে করোনায়। আগের তুলনায় বেশি হাসপাতালের সাপোর্ট লাগছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার করোনাভাইরাস আরও ব্যাপক শক্তিতে চাঙা হয়ে ফিরেছে। গতবারের করোনাভাইরাসের বদল ঘটেছে। আর সে পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে তরুণ সমাজও করোনার মারণ কামড় থেকে নিরপদ নয়। পাল্টে যাচ্ছে করোনায় মৃত্যুর সমীকরণ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশি হারে আক্রান্ত হওয়াকে এখন বিশ্বব্যাপী বিশেষ উদ্বেগের সাথে দেখা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণেই তরুণদের মনের ভেতর ভিড় করে থাকা নানা জটিলতা তাদের মানসিকভাবে আরও দূর্বল করে তুলেছে।
তারা বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে এই হার এত বেশি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কারণ হাসপাতালে থাকার ফলে এক ধরনের স্ট্রেস রয়েছে। আশপাশের অন্য রোগীদের দুর্দশা বা মৃত্যু দেখা, পরিবারের অবস্থার কথা ভেবে দুশ্চিন্তা ইত্যাদিও রয়েছে।
তবে গবেষকদের মতে, এই গবেষণা খুব অল্প সংখ্যক রোগীর ওপর করা হয়েছে। এমন গবেষণা আরও বড় মাত্রায় করা গেলে সামগ্রিক চিত্র আরও ভালো বোঝা যাবে। এই গবেষণার ভিত্তিতে সমস্যায় মোকাবিলা করার পদ্ধতিও ভাবা যেতে পারে।
এর আগে আমেরিকান নিউরোলজি একাডেমির প্রকাশিত নিউরোলজি জার্নালে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত তরুণ রোগীদের মধ্যে স্ট্রোকের হার ও ব্যাপকতা নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। করোনায় আক্রান্ত তরুণদের মধ্যে মেজর স্ট্রোকের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মেটা অ্যানালাইসিসে উঠে এসেছে আরও ভয়ংকর উপাত্ত- করোনার ফলে স্ট্রোকে আক্রান্ত তরুণদের শতকরা ৫০ ভাগ রোগী স্ট্রোকের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার সময়েও জ্বর-কাশি শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গহীন ছিলেন।
এ গবেষণাপত্রের লেখক, কানাডার স্কুলিস স্কুল অব মেডিসিন ও ডেন্টিস্ট্রিয়ের প্রধান স্ট্রোক বিজ্ঞানী ডা লুসিয়ানো স্পোসাটো আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তরুণদের ক্ষেত্রে স্ট্রোক কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম লক্ষণ হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ট্রোক বিশেষজ্ঞ ও এন্ডোভাস্কুলার নিউরোসার্জন ডা. মো. শফিকুল ইসলাম করোনায় স্ট্রোকের হার বৃদ্ধি সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেন- করোনাভাইরাস রক্তনালিতে ছোট ছোট মাইক্রোথ্রম্বি বা রক্তের দলা সৃষ্টি করে, রক্তনালির দেয়ালে প্রদাহ তৈরি করে যা আবার চক্রবৃদ্ধিহারে বৃহদাকার রক্তের দলা বা ক্লট জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
এই ক্লট ফুসফুসে গেলে মারাত্মক পালমোনারি অ্যাম্বোলিজম দেখা দেয়- বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হয়ে রোগীরা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তেমনিভাবে যে কোনো বয়সী মানুষের মস্তিষ্কের রক্তনালিতে এই ক্লট জমাট বাঁধলে ভেনাস সাইনাস থ্রোম্বোসিসসহ বড় রক্তনালির ব্লক হয়ে ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে। সাড়ে চার ঘণ্টায় বা গোল্ডেন অ্যাওয়ারের মধ্যে থ্রোম্বোলাইসিস বা থ্রোম্বোক্টমি করলে রোগীরা সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন।
করোনায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে মৃদু স্ট্রোকও সতর্কতার সঙ্গে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে জীবনসংহারী ফলাফল ঘটতে পারে।
হঠাৎ কথা জড়িয়ে যাওয়া, হাত-পায়ে অসাড়তা দেখা দিলে, চোখে ঝাপসা দেখলে বা তীব্র মাথা ব্যথা হলে দ্রুত নিউরোসার্জন ও স্ট্রোক বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের করোনায় আক্রান্ত স্ট্রোক রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। মহামারীতে যেন আর কোনো তরুণ জীবন স্ট্রোকের কবলে মারা না যায় বা প্যারালাইসিসে না ভোগে সবার এই বিষয়ে সচেতনতা ও সহযোগিতা কাম্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ